উপমহাদেশের মুসলমানদের আবহমান উৎসব-অনুষ্ঠানসমূহ

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ব্যক্তিত্ব

বর্তমান সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বিপ্লব। একদিকে ইউরোপ তার অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে একদল তথাকথিত মুসলিমরা পরিকল্পিতভাবে মুসলিম সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করছে, ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। যেন মুসলিম সংস্কৃতি বিশ্ব প্রগতির জন্য বাধাস্বরূপ। কিন্তু কোনো জাতির রূহ হলো সেই জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়, সভ্যতার ও এর অবকাঠামোর অন্যতম মাপকাঠি।

সংস্কৃতিকে বুঝতে গেলে এর মূলে যেতে হবে। একে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞার মাধ্যমে প্রকাশ করা অনেক কঠিন একটি বিষয়। গত কয়েক দশকেও এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। তবে ইংরেজি ব্যবহৃত ‘Culture’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সংস্কৃতি’-কে ব্যবহার করা হয়। যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো কৃষ্টি, অনুশীলন, প্রকর্ষ ইত্যাদি। একইসাথে আরবী ‘তহযিব’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘সংস্কৃতি’। সংস্কৃতি বুঝার ক্ষেত্রে দু’টি দিক অবশ্যই থাকতে হবে।

এক- জীবনের জন্য সংস্কৃতি প্রয়োজনীয় হতে হবে। জীবনকে বাদ দেওয়া যাবে না, জীবনের জন্যই হতে হবে।

দুই- যা কিছু সুন্দর নয় তা সংস্কৃতি হওয়া যাবে না।

মূলত, সংস্কৃতির ক্ষেত্র বিস্তৃত। যেমন- শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাষা, উৎসব, আইন-কানুন এসব সংস্কৃতির অংশ, তবে এটা শুধুমাত্র সংস্কৃতির নয় বরং মানুষের জীবনপদ্ধতিও সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত। সংস্কৃতি কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর জীবন বিচারে সহায়তা করে, যার সংস্কৃতি যতটা শক্তিশালী তার পরিচয়ও ততবেশি শক্তিশালী।

সংস্কৃতিতে রয়েছে সেই ভূমির ধর্মীয় ছাপ, যা সংস্কৃতির বিকাশের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সংস্কৃতি এবং ধর্ম এক না হলেও সংস্কৃতির উপর ধর্মের প্রভাব রয়েছে যা বৈরিতা না, বরং সহযোগিতাস্বরূপ। একটা সমাজে ধর্মের প্রভাব কেমন তা সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম সংস্কৃতি হচ্ছে আদর্শভিত্তিক। মুসলিম ধর্মীয় অনুসারীরা যে সংস্কৃতি বির্নিমাণ করে থাকে তা যে শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কল্যাণকর বিষয়টি মোটেও এমন না, একইভাবে এটি সেই জনপদের জন্যেও কল্যাণকর।

কুরআনুল কারীমে ইসলামকে ‘দ্বীনে মুবিন’ বলা হয়েছে; দ্বীন মানে হচ্ছে জীবনের একটা সুষ্ঠু আদর্শবাদ। মুসলিম সংস্কৃতি এই আদর্শবাদের ভিত্তিতে বিকশিত হয়েছে। ধর্মগত দিকের বাহিরে মুসলিম সংস্কৃতির পরিবেশগত দিকের জন্য যে রূপগত বৈচিত্র্য তা একইভাবে ইসলামে প্রাধান্য পেয়েছে।

একটি জাতির আত্মপরিচয় গড়ে উঠে সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে। একইভাবে হীনমন্য জাতি হওয়ার জন্যও সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। যেমন, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান। ইসলাম এসেছে প্রায় ৮০০ বছর হলো। ইসলামের প্রভাবে এখানে একটি মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছে এবং সেই সমাজকে ভিত্তি করে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশও ঘটেছে।

বিশ্বজুড়ে যতবার মুসলিম শাসনের আগমন হয়েছে, ততবার সেই ভূমির সাথে ইসলামী সংস্কৃতিকে যুক্ত করে সেই জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ একটি সংস্কৃতি উপহার দিয়েছে। যেহেতু তৈরিকৃত সংস্কৃতিতে স্বকীয় মাটির ছোঁয়া আছে, তাই সেই জনপদ এটাকে সাধুবাদ জানিয়ে বরণ করে নিতে কার্পণ্যবোধ করে নি। দ্বীন ও পরিবেশগত কারণে সৃষ্ট উৎসব এবং অনুষ্ঠানসমূহও সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত। তাই উপমহাদেশে ইসলাম আসার পর প্রথমে স্বাধীন সুলতান, পরে মোঘলরা রাজত্ব করে। এসময় মুসলমানরা ইসলামের আওতাধীন উৎসব যেমন: ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আজহা, রোজা পালন, শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় সহ আরো বেশ কিছু অনুষ্ঠান পালনের আবহ চালু করে।

উৎসব ও অনুষ্ঠানসমূহ মূলত মুসলমানদের একদিক থেকে যেমন আত্মিক ও নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ করে, ঠিক একইভাবে যুবসমাজকে উজ্জীবিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে যেমন মুসলিম যুবসমাজ উজ্জীবিত হয়েছিল, তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও উপকৃত হয়েছিল। কারণ হলো, উৎসব এবং অনুষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে মানুষ সমবেত হওয়ার সুযোগ পায়, যা সুস্থ ও স্বাভাবিক মনের বিকাশ সাধন করতে সাহায্য করে এবং মানুষ সত্য ও সুন্দরের সাক্ষাৎ পায়। আধ্যাত্মিক ছোঁয়া, সাংস্কৃতিক ভিত্তি, মৌলিক চাহিদা যেমন- বিনোদন, অবসরে প্রশান্তিপূর্ণ সময় ব্যয়, মানসিক শান্তি, নানাবিধ সামাজিক ক্ষেত্রসহ আরও নানান বিষয়কে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে ইসলাম ও পরিবেশগত নানাবিধ উৎসব ও অনুষ্ঠানসমূহ পালন করা হতো।

উপমহাদেশে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবই ছিলো সব সময়ই বেশি, যার কারণে একটি আর্দশভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতা চলমান অবস্থায় সংস্কৃতির বিকাশকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। কারণ, সংস্কৃতি একটি মানুষকে আদর্শহীন কিংবা আদর্শবান তৈরি করে। ইসলামী শাসনামলে ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব মানুষকে কতটা আর্দশবান হিসেবে তৈরি করেছিল তার জীবন্ত সাক্ষী হলো উপমহাদেশের সে সময়ের ইতিহাস।

আমাদের বর্তমান সময়ে যে সকল নৈতিক অবক্ষয় ফুটে উঠেছে তার জন্য  ইসলামী সংস্কৃতিকে পুর্নগঠন করতে হবে। তাই নীতিবান জাতি গঠনে ইসলামী সংস্কৃতিকে পাশ কাটানো সম্ভব না।

আমরা যদি আমাদের জাতিকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে চাই তবে সে সময়ের প্রচলিত মুসলিম সংস্কৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। উপমহাদেশে পালিত উৎসব ও অনুষ্ঠানসমূহের দিকে যদি তাকাই তবে দেখব যে,

• কারবালা দিবস ছিল প্রতিবাদের উৎসব। আশুরা ছিল নতুন বছরের পরিকল্পনা ও রোজা রাখার দিবস। মহররম পর্ব সকল সম্প্রদায় নিয়ে উৎসবমুখর হয়ে পালিত হতো। মুঘল আমলে শবে বরাত ও শবে কদর দিনটি ছিলো প্রার্থনা এবং ভোজানুষ্ঠানের দিন। এদিনে আলোকসজ্জার আয়োজন করা হতো। বাড়ীতে মসজিদে নারী-পুরুষ সকলে সারারাত ইবাদাত-বন্দেগী করতো। ভোজানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে দ্রব্যসামগ্ৰী বিতরণ করা হতো। শবে মেরাজকে কেন্দ্র করে কুদুসের চেতনা, প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরা হতো। যার মাধ্যমে মানুষজন অন্যায়কে প্রতিহত করতে শিক্ষা গ্রহণ করতো।

• মসজিদ নির্মাণ পরবর্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। ১৭০০ খৃষ্টাব্দে মুঘল আমলে ঢাকায় বেগম বাজারের করতলব খানের মসজিদ স্থাপনের সময়েও বেশ সমারোহ হয়েছিল। এটি মানুষের মধ্যে কার্পণ্যতা দূর করে অর্থকে আল্লাহর রাস্তায় দান করা শিখাতো এবং মানুষের কল্যাণে দান করার অনুপ্রেরণা যোগাতো।

• সামাজিক মেলামেশার আর একটি সুযোগ ছিল তখন মিলাদের আসরকে কেন্দ্র করে। বাড়ীর ছেলে-মেয়েদের পর্দার বিধানকে গুরুত্ব দিয়ে অমিয় সেই সুমিষ্ট তালে দোয়া-দরুদ শিক্ষায় উৎসাহিত করা হতো। মিলাদের পর সকলকে ঘন দুধে রান্না করা চিকন চালের ফিরনী, কিংবা জাফরানী জর্দা বিতরণ করা হতো ছোট ছোট তস্তরী করে। যা ছিল সে সময়ের অন্যতম সুন্দর একটি সংস্কৃতি, মানুষকে সামাজিকতার দিকে ধাবিত করতো।

• চার বছর চার মাস চারদিনে ‘বিসমিল্লাহখানি’ অনুষ্ঠান দ্বারা অক্ষর পরিচয় শুরু হতো। দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নামে পড়াশোনা শুরু করার জন্য শিশুদের মক্তবে পাঠানো হতো, এভাবে শিক্ষা জীবন শুরু করতো। মূলত জ্ঞানার্জন যে হাকীক্বত অন্বেষণ, তার শিক্ষাই সে সময়ে মক্তবে শিক্ষা দেওয়া হতো।

• শিশু সন্তান জন্মের পর আকিকা হচ্ছে মুসলমানদের একান্ত প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান। এ সময় শিশুপুত্রের জন্য দুটি এবং শিশুকন্যার জন্য একটি মহিষ বা ছাগল জবাই করা হতো এবং গোশতগুলো আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হতো। অবস্থাপন্ন পিতামাতা ভোজানুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণদের আপ্যায়ন করতেন। শিশু সন্তান জন্মের পর নামকরণ অনুষ্ঠানে বাংলায় মুসলমানগন ধর্মীয় গ্ৰন্থের সাহায্য নিতো। বাংলা মুসলমান সমাজে আরবী নামসমূহ প্রচলনের এটি একটি কারণ।

• খাতনা মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এটি সুন্নতে খাতনা নামেই বেশি সমাদৃত। সাধারণত সাত বছর বয়সের সময় শিশুপুত্রদের খাতনা করা হয়। এ উপলক্ষে মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসব অনুষ্ঠান পালন করত এবং ভোজ ও উপহারের আয়োজন করত।

• মুঘল আমলে মুসলমানগন সামাজিক ও সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করত। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো কবি, গল্পকথক, রসিকও সংগীতকারীদের প্রতিযোগীতায় সজীব হয়ে উঠতো।

• রমজান মাস মুসলমানদের জন্য তাকওয়া অর্জনের মাস। উপমহাদেশের মুসলিমরা রমজান মাসকে খুশির সাথে স্বাগত জানাতো। নানান রকম আয়োজন করে এই মাসকে বরণ করে নিতো এবং সর্বশেষদিন বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে বিদায় জানাতো। মূলত প্রতিটি রমজানকে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতে মুঘল সৈন্যরা রমজান মাসকে কেন্দ্র করে রমজানের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রত্যেকে প্রত্যহ বন্ধুর তাঁবুতে মিলিত হতো এবং সময় কাটাতো।

সকল উৎসবকে কেন্দ্র করে আর্ট শিল্প দিয়ে রাস্তা বাড়ীর দেয়াল নতুন করে সাজানো হতো। নানাবিধ সঙ্গীত, জিকির, তাকবীরে চারদিক মুখরিত হতো। মক্কা বিজয় দিবস সে সময় বিশ্বব্যাপী পালিত হতো। মাসব্যাপী সিরাতুন্নবী ও মিলাদুন্নবী পালিত হতো। বদর দিবসে শিখানো হতো আদালত প্রতিষ্ঠার শিক্ষা। পাখিদের কল্লোলের ন্যায় নানাবিধ মনোমুগ্ধকর নাশিদ, সাফিনায় রমজান মাস আমেজে ভরে উঠতো।

• মুঘলদের হাত ধরে ঈদ উৎসবকে সমৃদ্ধ করেন উপমহাদেশের মুসলিমরা। মুঘল আমলের বিভিন্ন চিত্রে ফুটে ওঠে সে সময়ের উৎসবের নানা দিক থেকে। মুঘল সৈন্যদের ছাউনি থেকে ঈদের আনন্দবার্তা ঘোষণার মাধ্যমে হত উৎসবের সূত্রপাত। নতুন চাঁদ দেখা গেলে বেজে উঠতো শাহী তুর্য অর্থাৎ রণশিঙ্গা। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত আতসবাজির প্রদর্শনী জানান দিত ঈদ এসে গিয়েছে। ‘ঈদের চাঁদ’ ইসলামের দৃষ্টিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। চাঁদ দেখার মাধ্যমে ঈদ নির্ধারিত হয়। ঈদের চাঁদ দেখার রাতকে বলা হয় চাঁদরাত। এই চাঁদ দেখার বিষয়টিও মুঘল দরবারে আলাদা মাত্র পেত।

নতুন পোশাক পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে মুসলমানগন ভোরে ঈদগাহ ময়দান বা ঈদের নামাজের স্থানে গমন করতো। অবস্থানপন্ন ও সাধারণ মুসলমানরা দরিদ্রদের টাকা-পয়সা ও উপহার দিতো। প্রত্যেক বাড়ী ভোজানুষ্ঠান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় সকলে মিলিত হয়ে আনন্দ স্ফূর্তিতে মুখরিত হতো।

ঈদ-ঊল-আজহা মুসলমানদের ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত। এদিনে মুসলমানগন ‘তাকবীর’ উচ্চারণ করতে করতে ঈদগাহ ময়দানের দিকে গমন করে।  কুরবানী সম্পন্ন হওয়ার পর বিরাট ভোজের আয়োজন করা হতো।

আমাদের মুসলিম সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে অনেক শক্তিশালী সংস্কৃতি, তবে বিশ্বায়নের যুগে যেভাবে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে তা মানবসভ্যতার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা ছাড়া আর কিছুই না। তবে আমাদের মুসলিম সভ্যতার সন্তান হিসেবে পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এটা কুরআনে বর্ণিত খলিফার এক অন্যতম দায়িত্ব।

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *