আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা চ্যান্সেলর: বেগম সুলতান জাহান

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ব্যক্তিত্ব

বেগম সুলতান জাহান— নামটি ভারতীয় উপমহাদেশের নারী ইতিহাস, ইসলামী শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারের পাতায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্ত। আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে, যখন নারীদের মতামত, শিক্ষাগ্রহণ বা সমাজে অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না, তখনই ভোপালের রাজ্য শাসন করেছিলেন একের পর এক নারী শাসক। এই ধারার শেষ মহীয়সী ছিলেন বেগম সুলতান জাহান— যিনি কেবল ভোপালের রাণীই ছিলেন না, ছিলেন সমাজজাগরণের অগ্রদূত, জ্ঞানচর্চার পৃষ্ঠপোষক এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য।

১৮৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করা এই মহিয়সী নারী ১৯০১ সালে ভোপালের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৯০৯ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত শাসনভার পরিচালনা করেন। তাঁর শাসনকাল ছিল একদিকে সংস্কার ও উন্নয়নের, অন্যদিকে শিক্ষার জাগরণের যুগ। নারী নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতার সময়েও তিনি পুরুষপ্রধান সমাজে দাঁড়িয়ে বাস্তবায়ন করেন অসংখ্য দৃষ্টান্তমূলক নীতি। শিক্ষার আলো, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর মর্যাদা ও মানবকল্যাণ— এই চার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই তিনি নিজের রাজ্যকে গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে।

শাসক হিসেবে বেগম সুলতান জাহানের বিচক্ষণতা ছিল অসাধারণ। দায়িত্ব গ্রহণের সময় রাজকোষে ছিল মাত্র ৪০,০০০ রুপী— যা কর্মচারীদের বেতন দিতেও যথেষ্ট ছিল না। অথচ কিছু বছরের মধ্যেই তিনি রাজ্যকে স্বাবলম্বী ও সমৃদ্ধ রাজ্যে রূপান্তরিত করেন। রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নে তিনি জনস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পানীয়জল সরবরাহ, টিকাদান কর্মসূচি এবং পৌরসভা নির্বাচনের মতো আধুনিক ব্যবস্থা চালু করেন। তাঁর উদ্যোগেই ভোপাল নগরীতে গড়ে ওঠে প্রাচীরঘেরা প্রশাসনিক কেন্দ্র ও রাজপ্রাসাদ।

তিনি নারী সমাজের জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিসরের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। ১৯১৩ সালে লাহোরে তিনি মহিলাদের জন্য একটি মিটিং হল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে নারীরা নিজেদের চিন্তা-ভাবনা ও মতামত বিনিময়ের সুযোগ পেতেন। এটি ছিল নারীর সামাজিক অংশগ্রহণের সূচনা। সেই সময় যখন নারীদের গৃহের বাইরে যাওয়া বিরল ঘটনা ছিল, তখন তাঁর এমন সাহসী উদ্যোগ সত্যিই বিস্ময়কর।

শিক্ষাক্ষেত্রে বেগম সুলতান জাহান ছিলেন এক বিপ্লবী নাম। তিনি ছিলেন সেইসব মুসলিম নারী সংস্কারকের উত্তরসূরি, যারা বিশ্বাস করতেন— জ্ঞানই মানবমুক্তির একমাত্র চাবিকাঠি। তিনি মেয়েদের শিক্ষা ও লালন-পালন বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন— দারস-ই-হায়াত, যা ছিল ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক জীবনবোধ ও শিক্ষাদর্শনের এক চমৎকার সংমিশ্রণ।

তিনি সুলতানিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, এবং বিদ্যমান মাদ্রাসা বিলকিসিয়া ও মাদ্রাসা ভিক্টোরিয়ার উন্নয়ন সাধন করেন। পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করেন ইংরেজি, গণিত, উর্দু, গৃহবিজ্ঞান, কারুশিল্প প্রভৃতি বিষয়। তিনি শিক্ষাকে সমাজের সব স্তরে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের জন্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোর ব্যয়ভার রাজকোষ থেকে বহন করা হতো, এবং কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল এলাহাবাদ বোর্ডের অধিভুক্ত।

নার্সিং পেশাকে ইসলামী মানবসেবার চেতনার সাথে যুক্ত করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লেডি মিন্টো নার্সিং স্কুল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও কলেজগুলোর মাধ্যমে নারী সমাজে আত্মনির্ভরতা, কর্মদক্ষতা ও নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেছিল। বেগম সুলতান জাহান মুসলিম মেয়েদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মেয়েদের শিক্ষার প্রতিও সমান গুরুত্ব দেন। তিনি হিন্দু, জৈন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আর্থিক সহায়তা দান করেন, যা তাঁর উদার মনোভাব ও মানবিকতার প্রতিফলন।

তাঁর অর্থায়নে আলীগড়, দিল্লি, বোম্বে, কলকাতা, এমনকি মক্কা মদীনার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধ হয়েছিল। লাখনৌয়ের নাদওয়াতুল উলুম ও দেওবন্দের মাদ্রাসাও তাঁর অনুদান পেয়েছিল। এইভাবে তিনি উপমহাদেশের ইসলামী শিক্ষার ধারাকে নতুন প্রাণ দান করেন।

ভোপালে তিনি একটি লেডিস ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে মুসলিম নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিষয়ে আলোচনা করতে পারতেন। অল ইন্ডিয়া উইমেন অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে তিনি বড় বড় সম্মেলনের আয়োজন করেন, বক্তৃতা দেন এবং নারী সমাজকে শিক্ষিত ও সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি “সুলতান জাহান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট” গঠন করেন, যা তিন লাখ রুপির মূলধনে গঠিত হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী ও দুঃস্থ পরিবারের সহযোগিতা করেছিল।

বেগম সুলতান জাহানের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন— আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর অঙ্গাঙ্গিক সম্পর্ক। তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহিলা উপাচার্য (চ্যান্সেলর)। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় তখন মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ নামে পরিচিত ছিল। তিনি এর উন্নয়ন, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং নারী শিক্ষার সম্প্রসারণে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন।

শেখ আবদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত আলীগড় গার্লস স্কুলে তিনি নিয়মিত অর্থানুকূল্য প্রদান করতেন এবং পাঠ্যসূচি নিজেই নকশা করতেন। তাঁর দানেই প্রতিষ্ঠিত হয় আলীগড়ের “সুলতান জাহান মঞ্জিল” — যা মুসলিম নারী শিক্ষার এক প্রতীকী স্থাপনা।

১৯২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং তাঁর ভাষণে মুসলমান জাতির জাগরণের আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন —

“আজ মুসলমানদের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যখন এই সময়ের ইতিহাস লেখা হবে, আজকের এই অনুষ্ঠান তার একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে।”

তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সেই প্রতিষ্ঠানই বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের বিশটিরও বেশি দেশ থেকে ছাত্রীদের আগমন ঘটে— এর শিকড় স্পর্শ করে আছে বেগম সুলতান জাহানের রচিত ইতিহাসে।

বেগম সুলতান জাহান ছিলেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সমাজ সংস্কার, নারীশিক্ষা ও মানবসেবার প্রতীক। তিনি প্রায় ৪১টি গ্রন্থ রচনা করেন, যার অনেকগুলো বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন কেবল একজন শাসক নন, একজন বুদ্ধিজীবী, একজন সংস্কারক, একজন জনহিতৈষী— যিনি তাঁর সময়ের বহু দূরে এগিয়ে ছিলেন চিন্তা, আদর্শ ও কর্মে।

১৯৩০ সালের ১২ মে, ৭১ বছর বয়সে তিনি পরপারে যাত্রা করেন। তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও জীবন্ত— ভোপালের রাজপ্রাসাদে, আলীগড়ের প্রাচীন ভবনে, এবং নারী শিক্ষার প্রতিটি স্তরে।

ইতিহাস তাঁকে শুধু ভোপালের এক নারী শাসক হিসেবে নয়, বরং মুসলিম দুনিয়ার নারী জাগরণের প্রথম আলোকবর্তিকা হিসেবে স্মরণ করে। বেগম সুলতান জাহান আমাদের দেখিয়ে গেছেন— কীভাবে ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক সফল রাষ্ট্র, এক আলোকিত জাতি, এক শিক্ষিত নারীসমাজ।

তিনি ছিলেন সময়ের বহু আগে জন্মানো এক নারী—

যিনি পরিবর্তনের পথ দেখিয়ে গেছেন,

আর রেখে গেছেন ইতিহাসে তাঁর অমর স্বাক্ষর।

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *