শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা এবং সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় — বাংলার প্রথম ইসলামী বিদ্যাপীঠের উজ্জ্বল ইতিহাস

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ

বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও কেবল রাজনীতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্রই ছিল না, ছিল জ্ঞান, সাধনা ও সংস্কৃতিরও এক উর্বর ভূমি। এই সোনারগাঁওকে আলোকিত করেছিলেন অসংখ্য সাধক, সুফি ও পণ্ডিত, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা—বাংলার বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের এক দীপ্ত নক্ষত্র, যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

১৩শ শতাব্দীর বাংলায় যখন মুসলিম সমাজ ও রাজনীতি নতুন রূপ নিচ্ছে, তখন সোনারগাঁও ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিল জ্ঞানচর্চা ও তাসাউফ সাধনার কেন্দ্র। এই নবজাগরণের মূল প্রেরণাশক্তি ছিলেন শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, তিনি ছিলেন আরব উপদ্বীপের বুখরা (বর্তমান উজবেকিস্তান বা ইয়েমেন অঞ্চল) থেকে আগত এক মহান আলেম ও সুফি সাধক। জন্ম আনুমানিক ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে, মৃত্যু ১৩০১ সালে সোনারগাঁওয়ে। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ব্যয় করেন জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজসংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে।

তাঁর অশেষ প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য ও নেতৃত্বগুণে অল্প সময়ের মধ্যেই সোনারগাঁও হয়ে ওঠে বাংলার বাগদাদ, জ্ঞানের এক উজ্জ্বল নগরী, যেখানে শিক্ষার্থী, আলেম ও সুফিরা দূরদেশ থেকে ছুটে আসতেন জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে।

ইতিহাসবিদদের মতে, শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী একাডেমি—যা কার্যত ছিল উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার, যা তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এখানে কেবল ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, পড়ানো হতো হাদীস, ফিকাহ, তাফসির, পাশাপাশি ভূগোল, গণিত, যুক্তি, রসায়ন ও চিকিৎসাবিদ্যা।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ইসলামী সভ্যতার আদর্শে গঠিত—যেখানে জ্ঞান ছিল ইবাদতের অংশ, এবং প্রতিটি শিক্ষার্থী ছিল সমাজের সেবায় নিবেদিত। ড. এম. এ. রহিম যথার্থই বলেছেন—

“শায়েখ আবু তাওয়ামা ছিলেন সোনারগাঁও ও পূর্ব বাংলার মহান গৌরবের প্রকৃত কর্ণধার।”

তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ ছিল কেবল জ্ঞানের আলোছায়া নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক পুনর্জাগরণের কেন্দ্র। তাঁর নেতৃত্বে সোনারগাঁও এক সময় সমগ্র ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষার প্রধান আসন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।

শায়েখ আবু তাওয়ামা ছিলেন একাধারে জ্ঞানী ও সাধক, যুক্তিবাদী ও রহস্যময়। তিনি কেবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেননি—গড়ে তোলেন খানকাহ, যেখানে সাধারণ মানুষও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ লাভ করত।

তাঁর দরবারে দিনে বিদ্যা আলোচনা আর রাতে হতো জিকির, কিরআত ও মুর্শিদি সঙ্গীতের আসর। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত আলেম, মুরিদ, সুফি ও শিক্ষার্থী এসে জমায়েত হতো সেখানে। ফলে সোনারগাঁও পরিণত হয় এমন এক বহুমাত্রিক নগরীতে, যেখানে একত্রে বিকশিত হচ্ছিল বিজ্ঞান, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য ও আত্মসাধনা।

শায়েখ আবু তাওয়ামা ছিলেন হাদীস ও ফিকাহশাস্ত্রে অতুলনীয় পণ্ডিত। তাঁর বিশেষজ্ঞতা কেবল ধর্মীয় জ্ঞানে সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি ভূগোল, গণিত, রসায়ন, দর্শন ও তাসাউফে ছিলেন সমান দক্ষ।

তাঁর লিখিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

‘মানজিলে মাকামাত’ — তাসাউফ ও আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ভিত্তিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ।

‘নামাজে হক’ — ফার্সি ভাষায় রচিত এক অনন্য কাব্যগ্রন্থ, যেখানে নামাজের ফিকহ ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ১৮০টি কবিতার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে।

এই গ্রন্থটি পরবর্তীকালে ‘মসনবী বনামে হক’ নামে পরিচিতি পায় এবং ১৮৮৫ সালে বোম্বে ও ১৯১৩ সালে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। ধারণা করা হয়, তাঁর বহু অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি আজও ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে।

ঐতিহাসিকদের মতে, আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত একাডেমির শিক্ষার মান ও প্রভাব তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠসমূহের সমকক্ষ ছিল—যেমন বাগদাদের মাদরাসাতুল মুস্তানসিরিয়া, মিশরের আল-আজহার, মরক্কোর ফেজ, কিংবা স্পেনের কর্ডোভা ও গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিদ্যাপীঠ কেবল শিক্ষা নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তারও কেন্দ্র ছিল। এর নিজস্ব নৌবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী ছিল—যারা জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি বাংলার জনসাধারণের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করত। বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল জাতীয় ঐক্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও হানাদার প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু।

তবে ইতিহাসের চাকা ঘুরে যায়। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার মৃত্যুর পরও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় বহুদিন টিকে ছিল। ধারণা করা হয়, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের আমল পর্যন্ত এটি শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার পালাবদলে, রাজা গনেশের উত্থানের পর, ইসলামী একাডেমির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে জ্ঞানমন্দিরের সেই স্থল মানুষে মানুষে পূর্ণ হয়, পরিণত হয় আবাসস্থলে। সময়ের ধুলোয় হারিয়ে যায় এক স্বপ্নিল ইতিহাস। আজ সোনারগাঁওয়ের কিছু ভগ্নপ্রাচীর, চুন-সুরকির দেয়াল আর কাহিনির স্মৃতিই সাক্ষ্য দেয় সেই জ্ঞানের রাজ্যের অস্তিত্বের।

যদিও সোনারগাঁওয়ের বিশ্ববিদ্যালয় আজ বিলুপ্ত, তবে এর উত্তরাধিকার এখনো জীবন্ত বাংলার সংস্কৃতি, ধর্ম ও শিক্ষাচেতনায়। শায়েখ আবু তাওয়ামার রোপণ করা জ্ঞানের বীজ থেকে বিকশিত হয়েছে পরবর্তী শতাব্দীগুলোর ইসলামী চিন্তাধারা, ফিকহশাস্ত্র, এবং সুফি দর্শনের ধারা।

তাঁর অবদান স্মরণ করা মানে কেবল অতীতের স্মৃতি রোমন্থন নয়, বরং বাংলার জ্ঞান ও সভ্যতার ভিত্তিকে পুনরায় উপলব্ধি করা। সোনারগাঁওয়ের মাটিতে আজও যেন তাঁর আত্মার ছোঁয়া আছে—প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধ্বংসাবশেষে যেন উচ্চারিত হয় এক অনন্ত আহ্বান:

“জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই মুক্তি; আর সত্য জ্ঞানের আলো কখনও নিভে না।”

শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা ছিলেন কেবল একজন আলেম নন—তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম জ্ঞানবিপ্লবের নায়ক, যিনি সোনারগাঁওকে পরিণত করেছিলেন ইসলামী শিক্ষার তীর্থক্ষেত্রে। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠশালা নয়, ছিল এক সভ্যতা নির্মাণের কেন্দ্র।

আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয় নেই, নেই ছাত্রদের কোলাহল; কিন্তু তাঁর গড়া আদর্শ আজও সময়ের দেয়ালে খোদাই হয়ে আছে।

কালের পরিক্রমায় ইতিহাস হয়তো নীরব, কিন্তু আবু তাওয়ামার প্রজ্ঞা আজও অনুপ্রেরণা জোগায় প্রতিটি আলোকপ্রেমী মানুষকে—যারা বিশ্বাস করে, জ্ঞানই মানবতার শ্রেষ্ঠ দান।

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *