এগারো সিন্ধু দুর্গ বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারো সিন্ধু গ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ। এটি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
‘এগারো সিন্ধু’ নামটির উৎস নিয়ে দুইটি জনপ্রিয় মত রয়েছে।
প্রথমত, ঐ এলাকায় প্রবাহিত ১১টি নদীর স্মৃতিকে স্মরণ করে এই নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
দ্বিতীয়ত, জনশ্রুতি মতে, সিন্ধু প্রদেশ থেকে ১১ জন সুফি আউলিয়া ইসলাম প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে আগমন করেন। তাঁদের সম্মানার্থেই এই এলাকার নাম ‘এগারো সিন্ধু’ এবং দুর্গটির নামকরণ হয় ‘এগারো সিন্ধু দুর্গ’।
মোগল শাসনামলে বাংলায় একদল প্রভাবশালী স্বাধীন জমিদারের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে নিজস্বভাবে জমিদারি পরিচালনা করতেন। এঁদের সম্মিলিতভাবে ‘বারো ভূঁইয়া’ নামে অভিহিত করা হয়।
বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ও প্রধান নেতা ছিলেন মীর মসনদে আ’লা ঈশা খাঁ। তিনি ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সোলায়মান খাঁ আফগান জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের আদি নিবাস ছিল আফগানিস্তানে।
১৫৪৫ সালে শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ সিংহাসনে আরোহণের পর ঈশা খাঁর পিতা দাউদ খাঁ কররানীকে হত্যা করেন। পরবর্তীতে ঈশা খাঁ ও তাঁর ছোট ভাই ইসমাইল খাঁকে তুরানী বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁদের চাচা কুতুব খাঁ পরবর্তীতে ব্যক্তিগত অর্থায়নে দুই ভ্রাতাকে মুক্ত করে আনেন।
বাংলার জমিদাররা মোগল ও ইংরেজদের শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে ঈশা খাঁকে বাংলায় ফিরে আসার অনুরোধ জানান। এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঈশা খাঁ তাঁর ১৪০০ ঘোড়সওয়ার, ২১টি নৌবহর ও পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রসহ বাংলায় আগমন করেন।
১৫৯৮ সালে ঈশা খাঁ ত্রিপুরায় এসে মোগল সেনাপতি রাজা দূর্জন সিংহ ও মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই যুদ্ধেই মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ নিজ হাতে তাঁকে আরেকটি তরবারি তুলে দেন। এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে মানসিংহ ঈশা খাঁর কাছে পরাজয় স্বীকার করেন। ধারণা করা হয়, এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল এগারো সিন্ধু দুর্গের অভ্যন্তরে।
এগারো সিন্ধু দুর্গটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। দুর্গটির নির্মাতা সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেন এটি নির্মাণ করেন রাজা আজহবা, কেউ বলেন কোচ হাজং উপজাতির নেতা বেবুধ (বা ইবন রফুধ), আবার কেউ বলেন গৌড় গোবিন্দের কোনো সহচর এই দুর্গ নির্মাণ করেন।
তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, দুর্গের নিকটবর্তী এলাকায় মধ্যযুগীয় স্থাপত্য নিদর্শন এবং বেবুধ রাজার দিঘির উপস্থিতি থেকে অনুমান করা যায়, কোচ হাজং উপজাতির প্রধান নেতা বেবুধ রাজাই দুর্গটির নির্মাতা ছিলেন।
পরবর্তীতে ঈশা খাঁ বেবুধ রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে দুর্গটি দখল করেন এবং এটিকে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন।
১৭ শতকের শুরুর দিকে আহোমদের একটি দল দুর্গটি আক্রমণ করে। মোগল সুবাদার ইসলাম খান তাঁদের পরাজিত করেন এবং দুর্গটি ধ্বংস করে দেন। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে দুর্গের বাকি কাঠামোও ভেঙে পড়ে। আজ দুর্গটির মূল কাঠামোর কিছুই অবশিষ্ট নেই — কেবল কিছু ঢিবি ও স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া।
বর্তমানে অবশিষ্ট নিদর্শনসমূহ
বর্তমানে এগারো সিন্ধু দুর্গের মূল কাঠামো প্রায় বিলুপ্ত হলেও, এর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এখনো বিদ্যমান:
১. সাদী মসজিদ (১৬৫২ খ্রি.)
এই মসজিদটি পুরোপুরি পোড়ামাটির অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। এটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির, যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট। চার কোণে রয়েছে চারটি বুরুজ। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে, যেখানে এখনও পোড়ামাটির ফলকের সুদৃশ্য নকশা দেখা যায়। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে তিনটি টেরাকোটায় অলংকৃত মেহরাব।
ইতিহাসবিদদের মতে, মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে, ১০৬২ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে, শেখ নিরুর পুত্র সাদীর উদ্যোগে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। সেই সূত্রে মসজিদটির নাম হয় ‘সাদী মসজিদ’।
২. শাহ্ মাহমুদ মসজিদ (১৫৮০ খ্রি.)
মসজিদটির প্রতিটি বাহু ৩২ ফুট দৈর্ঘ্যের এবং চার কোণে চারটি বুরুজ রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালে অভ্যন্তরে তিনটি মেহরাব আছে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যধারায় নির্মিত এই মসজিদটি শাহ্ মাহমুদের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। ধারণা করা হয়, এটি ১৬শ শতকের দিকে নির্মিত।
৩. বেবুধ রাজার দিঘি
এগারো সিন্ধু দুর্গের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হলো বেবুধ রাজার খনন করা বিশাল দিঘি। ধারণা করা হয়, দুর্গকে রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করার সময় এই দিঘি খনন করা হয়। এই দিঘি ও তাকে ঘিরে নানা উপকথা আজও স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত রয়েছে।
ঐতিহ্য বিলুপ্তির অন্তিম প্রহর
বর্তমানে এগারো সিন্ধু দুর্গের কোনো দৃশ্যমান অবকাঠামো অবশিষ্ট নেই। কিছু ঢিবি ও একটি রহস্যময় কবর দেখা যায়, যার পরিচয় আজও অনিশ্চিত। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় আনা হলেও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে দুর্গের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিলুপ্তির পথে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীরা আজও এই ঐতিহাসিক দুর্গের নিদর্শন দেখতে আসেন, কিন্তু দেখতে পান শুধুই নীরব ইতিহাসের চিহ্নমাত্র — একটি শ্যাওলা ধরা কবর, কিছু ভগ্নাবশেষ আর দিঘির নির্জন জলরাশি।
এগারো সিন্ধু দুর্গ শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বরং এটি বাংলার স্বাধীনতাকামী জমিদার ও বীর ঈশা খাঁর প্রতিরোধ সংগ্রামের সাক্ষ্যবাহী এক ইতিহাস। এ দুর্গে লুকিয়ে আছে বিজয়, প্রতিরোধ, মহানুভবতা এবং স্বাধীনতার স্পন্দন। যথাযথ সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে এই ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে জীবন্ত করে তোলা জরুরি।