নবজাগরণের শিল্পী আব্বাস উদ্দিন

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ব্যক্তিত্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতি

আব্বাস উদ্দিন ছিলেন একজন বাঙালি লোকসংগীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, পল্লীগীতিশিল্পী৷ একজন সংগীত শিল্পী হিসেবে আব্বাস উদ্দিনের খ্যাতি ছিল সারাদেশ জুড়ে৷ আধুনিক গান, ইসলামি গান, স্বদেশী গান,পল্লীগীতি সব ধরনের গানই তিনি গেয়েছেন৷ তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি৷ গানের জগতের ক্ষেত্রে তার কোনো ওস্তাদ ছিল না৷

গ্রামের যাত্রাপালা থেকে তার গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়৷ যাত্রা, থিয়েটার, স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে আপন প্রতিভা-বলে তিনি সবার সামনে নিজেকে তুলে ধরেন৷  তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লী গায়ের একজন গায়ক৷ কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খার নিকট  উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছিলেন৷ রংপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, চটকা,ক্ষীরোল গেয়ে আব্বাস উদ্দিন প্রথমে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন৷ তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদি, মুর্শিদি, পালাগান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন৷ তিনি তার দরদ ভরা সুরেলা কন্ঠে পল্লী গানের সুর এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা আজও অদ্বিতীয়৷

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আব্বাস উদ্দিন আত্মপ্রকাশ করেন আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে৷ আব্বাস উদ্দিন যে সময়ে গান শুরু করেন তা ছিল বাংলার মুসলিম সমাজের নবজাগরণের সময়৷ আব্বাস উদ্দিনকে তাই নবজাগরণের শিল্পী বললে ভূল হবে না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরা তাদের রচনার মধ্য দিয়ে মুসলিম চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি সুমধুর গানের কলি দিয়ে আব্বাস উদ্দিন বাংলাকে জাগ্রত করেছিলেন। কুচবিহারে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তার পরিচয় হয়৷ তিনি আব্বাস উদ্দিনকে বেশ স্নেহ করতেন৷ কাজী নজরুল ইসলাম আব্বাস উদ্দিন কে তার ছোট ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন৷ তিনি প্রায় বিশ বছর কাজী নজরুল ইসলামের সহচার্যে ছিলেন৷ আব্বাস উদ্দিন নজরুলের অনেকগুলো গান রেকর্ড করার কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়৷ তিনি নজরুল ইসলামের সহযোগিতায় কলকাতায় এসে গ্রামোফোন রেকর্ডে অনেকগুলো গান রেকর্ড করেন৷ তার প্রথম রেকর্ড ‘কোন বিরহের নয়ন জলে বাদল গো’ এবং ‘স্মরণ পিঠের ওগো প্রিয় বাজারে’ বের হওয়ার পর ব্যাপকভাবে সারা ফেলে৷ শহুরে জীবনেকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব আব্বাস উদ্দিনের৷ আব্বাস উদ্দিন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন৷ প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে ও পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানীর চাকরি করে৷ একে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে তিনি সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন৷ ৪০ শতকে আব্বাস উদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ের বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে৷ দেশবিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় এসে তিনি সরকারের  প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন৷

আব্বাস উদ্দিনের প্রসঙ্গে ফরহাদ মাজহার বলেন, “আব্বাস উদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাস উদ্দিন কেবল গান গেয়ে মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে৷ আব্বাস তার সময়কালের আকাঙ্খা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেকে৷”

কাজী নজরুল ইসলাম,গোলাম মোস্তফা, জসিম উদ্দিন প্রমুখ ব্যাক্তিদের ভাবধারায় রচিত অনেক গানে তিনি কন্ঠ দিয়েছেন৷ বলা হয় কাজী নজরুল ইসলামের রচিত জনপ্রিয় গান ‘ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই গানের পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য৷ তিনিই কাজী নজরুল ইসলামকে গানটি রচনা করতে প্রেরণা দেন। কেবল বানিজ্যিকভাবেই নয়, বরং মানুষ এটি হৃদয় দিয়ে ধারণ করেন৷ বলা হয়ে থাকে মানুষ যে সময় গান শুনলে কানে আঙুল দিতো তারাই কান থেকে আঙুল সরিয়ে গান উপভোগ করেন৷ আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া বেশ কিছু জনপ্রিয় ইসলামি গান হলো :

* ও মোর রমজানের ও রোজার শেষ

* রোজ হাশরে আল্লাহ আমার

* দে যাকাত দে যাকাত

* হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড়

* তাওহিদেরই মুরশিদ আমার

* ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ

* ইসলামের ঐ সওদা লয়ে

* মোহাম্মদ এর নাম জপেছিলি

* শোন শোন ইয়া ইলাহি

* আল্লাহতে যার পূর্ণ ইমান

* শোন মোমিন মোসলমান ও

এসব গান ছাড়াও তিনি জারি, সারি, ভাটিয়ালি গান গেয়েছেন৷ তার জনপ্রিয় আরো কিছু গান হলো

* আমায় ভাসাইলি রে

* নদীর কুল নাই

* আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায়

* ধিক ধিক মইশাল রে

* নাও ছাড়িয়া দে

* মাঝি বাইয়া যাও রে

* আল্লাহ মেঘ দে পানি দে

* ও গড়িয়াল ভাই

* দিকে দিকে পূর্ণ

* প্রেম জানে না রসিক কালাচান

* উঠুক তুফান পাপ দরিয়ায়

আব্বাস উদ্দিন কেবলমাত্র একজন শিল্পীই নয় বরং তিনি  হলেন একটি দশকের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা৷ আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে যে জাদু ছিল তা অন্য কারো মাঝে ছিল না৷ সঙ্গীতে অবদানের জন্য তাকে মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরম্যান্স (১৯৬০),শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন৷ বাঙালী জাতির নিকট তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন৷

সংকলন : সুমাইয়া বুশরা

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *