বর্তমান বিশ্বে নারী এবং সমাজে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নানাবিধ সামাজিক সংকটের উদ্ভব ঘটেছে। এ সমস্যাগুলো কারও কাছে অত্যন্ত তীব্র আকারে ধরা দেয়, আবার কারও কাছে তুলনামূলকভাবে কম প্রকট। তবুও সত্য হলো—বিশ্বের এমন অঞ্চল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যেখানে এই সংকটের ছায়া পড়েনি। তাই সম্ভাব্য সমাধান অনুসন্ধান করা এখন সময়ের এক অনিবার্য দাবি—এ কথাটি আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই গবেষণায় আমি “নারী সমস্যা”কে কুরআনের আলোকে বিশ্লেষণ করেছি। আর যে ধারণাটি আমি সামনে এনেছি তা হলো—”কুরআনিক সমাজ”। কারণ, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে সমাজ সংস্কারের জন্য কুরআন যে জীবনমুখী ও ফলপ্রসূ দিকনির্দেশনা প্রদান করে, তার তুলনা অন্য কোনো মডেল, তত্ত্ব বা সাহিত্যে পাওয়া দুরূহ।
এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন জাগতে পারে—এই প্রবন্ধের শিরোনাম কেন “কুরআনিক সমাজে নারী” রাখা হলো? কেন নয় “মুসলিম সমাজে নারী” অথবা “ইসলামি সমাজে নারী”?
আসুন, আমরা এবার এই প্রশ্নের ব্যাখ্যায় প্রবেশ করি।
এই প্রবন্ধে আমি সচেতনভাবেই “মুসলিম” কিংবা “ইসলামি” শব্দদ্বয়ের ব্যবহার পরিহার করেছি। এর পরিবর্তে আমি তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত একটি শব্দ—“কুরআনিক সমাজ”—গ্রহণ করেছি। এ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক কারণ।
প্রথমত,
আমাদের সমাজে এমন বহু প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রথা বিদ্যমান, যা ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামি’ পরিচয়ে বহুলভাবে পরিচিত হলেও বাস্তবে সেগুলোর অনেকটাই ইসলামের মর্যাদা বা স্বীকৃতির দাবিদার নয়।
আজকের বিশ্বে প্রায় চল্লিশটি দেশ নিজেদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে দাবি করে এবং নিজস্ব মনগড়া সামাজিক কাঠামোকেই “ইসলামি সমাজ” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। এই বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—এসবের মধ্যে আসলেই কোন সমাজকে আমরা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করব? কোন সমাজ প্রকৃত অর্থে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহিমান্বিত আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে?
প্রতিটি মুসলিম দেশই দাবি করে—তাদের সমাজই ইসলামি আদর্শের প্রকৃত অনুসারী। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এ দাবির পেছনে সত্যিই কি ইসলামের নির্যাস রয়েছে, নাকি কেবল মুখের বুলি?
অন্যদিকে দেখা যায়, অমুসলিম গবেষকগণ—বিশেষত পাশ্চাত্যের নৃতাত্ত্বিক ও সমাজবিশ্লেষকরা, যারা দেশ থেকে দেশে ভ্রমণ করে মানুষের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির রূপ-রস সংগ্রহ করেন—তাঁরা মুসলিম সমাজের বিচিত্র রীতি-নীতি, আঞ্চলিক রেওয়াজ কিংবা জাহিলিয়াতের অবশিষ্টাংশকেও ইসলামের জীবন্ত নিদর্শন ভেবে বিভ্রান্ত হন। অথচ এসবের অনেক কিছুই ইসলামের মৌলিক আকীদা ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বরং সরাসরি বেমানান।
তাদের এই সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলনা করা যায় তথাকথিত “জু-তত্ত্ব (Zoo Theory)”–এর সঙ্গে। এ তত্ত্বের অনুসারীরা মুসলিম উম্মাহ এবং অ-পাশ্চাত্য জাতিগোষ্ঠীকে চিড়িয়াখানার প্রদর্শনীর বিচ্ছিন্ন একেকটি নমুনা হিসেবে দেখে। ইসলামকে তারা আল্লাহর নাজিলকৃত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে উপলব্ধি না করে, বরং স্থানীয় লোকাচার ও প্রথাকে ইসলামি পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে প্রচার করে। ফলে তাওহিদ, তাকওয়া, ওহী ও শরিয়াভিত্তিক জীবনব্যবস্থা তাদের চোখে অদৃশ্য থেকে যায়। এই রূহানিয়াতবিচ্ছিন্ন ইসলাম শেষ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং আকীদা ও ঐক্যের মূলভিত্তিকে নষ্ট করে ফেলে।
আসলে, এদের গবেষণা অনেকটা এক অচেনা বনের অভিযাত্রীর মতো—যারা সর্বদা খুঁজে বেড়ায় ‘অদ্ভুত’ ও ‘ব্যতিক্রমী’ দৃশ্য। মুসলিম সমাজে তারা যেখানে কোনো বিচিত্র রীতি-নীতি বা লোকাচার খুঁজে পায়, সঙ্গে সঙ্গে তা ক্যামেরায় বন্দি করে, খাতায় টুকে রাখে—এবং সেখান থেকেই গড়ে তোলে তাদের কল্পিত ‘ইসলাম’।
এইভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ভূখণ্ডে ঘুরে বেড়িয়ে তারা যেসব ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে, তা মূলত লোকাচার ও সংস্কারভিত্তিক কিছু কাঁচা তথ্যমাত্র। অথচ “জু-তত্ত্বের” অনুসারীদের দৃষ্টিতে সেটাই হয়ে ওঠে ইসলামের প্রতিচ্ছবি। তাদের গবেষণায় কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক ইসলামের প্রকৃত উপলব্ধির প্রতি আন্তরিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত সীমিত। ফলে, তাদের মনে পূর্ব থেকেই যে সংশয় ছিল, তা এই জায়গায় এসে আরও দৃঢ় রূপ পায়। এর ফলশ্রুতিতে তারা এই ধারণা নিয়ে ফিরে যায় যে, পৃথিবীতে কোনো একক ও শাশ্বত ইসলাম নেই—বরং রয়েছে বহু ভিন্নমুখী ইসলাম।
ঠিক একইভাবে, তারা মন্তব্য করে যে মুসলিম সমাজে নারীর মর্যাদা ও ভূমিকা নিয়েও বহু মত ও বহু ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। আর প্রতিটি ব্যাখ্যাকেই তারা “ইসলামি” বা “মুসলিম” বলে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু একজন মুমিন হিসেবে আমরা জানি—এসবের অনেক কিছুই নিছক বিভ্রান্তি, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রথা বা কুসংস্কার ব্যতীত আর কিছু নয়। কিছু জাহিল মানুষ দীর্ঘমেয়াদী অনিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সমাজে এর ভিত্তি স্থাপন করেছে। ধীরে ধীরে তা বিস্তার লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। অথচ এসব কার্যক্রমের সাথে মূল তাওহিদি দৃষ্টিভঙ্গির কোনো সম্পর্ক নেই; বরং এসব মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে, বুঝতে এবং গবেষণা করতে চূড়ান্তভাবে বিভ্রান্ত করে।
আমার লেখনীতে এই বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্যই আমি সচেতনভাবে “কুরআনিক” (কুরআনভিত্তিক) শব্দটির ব্যবহার করেছি। আমার উদ্দেশ্য হলো বিষয়টিকে “জু-তত্ত্বের” সেই খণ্ডিত ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এনে, একটি ঐক্যবদ্ধ ও আদর্শিক ইসলামের মৌলিক দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা।
মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব নির্ধারণকারী বিষয়গুলোতে আমরা কখনোই তাদের টার্গেটকৃত “মানব চিড়িয়াখানা” (Human Zoo Theory) তত্ত্বের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকতে পারি না। বিশেষ করে সেইসব মানুষের গল্পে বা আচরণে, যাদের কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যাদের সংস্কার ও লোকাচারকে ভুলভাবে ইসলামিক লেবেল দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। এ ধরনের নামকরণই প্রায়শই মানুষকে বিভ্রান্তির গভীরে ঠেলে দেয়।
অপরদিকে, “কুরআনিক” শব্দটি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। এটি আলোচনার প্রকৃত বিষয়বস্তুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং আমাদের আহ্বান জানায় কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামকে উপলব্ধি ও পর্যালোচনা করতে।
দ্বিতীয়ত,
“কুরআনিক সমাজ” শিরোনামটিকে আমি সর্বাধিক উপযুক্ত মনে করি, কারণ এটি আমাদের আহ্বান জানায় আল-কুরআনের সেই মৌলিক নীতিসমূহের দিকে, যেগুলোর ভিত্তিতেই একটি মুসলিম উম্মাহর সমাজ কাঠামো গড়ে উঠা উচিত। আমাদের প্রত্যাশা এমন একটি সমাজ, যার ভিত্তি হবে কুরআনের নির্দেশিত মূলনীতি। যদিও বাস্তব জীবনে অনেক সময় আমরা অজ্ঞাতসারেই এই নীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হই, তবুও আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি তাওহিদভিত্তিক ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গঠন করা—যার কেন্দ্রবিন্দু হবে আল্লাহ তা‘আলার নাজিলকৃত সেই মহামহিম কিতাব, আল-কুরআন।
আমাদের সমাজ কোনো বিশেষ জাতিগত সংস্করণের প্রতিরূপ নয়—না তা ইন্দোনেশীয়, না পাকিস্তানি, না সৌদি, না মিশরীয়। বরং এটি হবে এমন এক আদর্শ সমাজ, যা জাতি-ভাষা-বর্ণ নির্বিশেষে কুরআনের আলোয় গড়ে ওঠে।
নারীর মর্যাদা, অধিকার এবং সামাজিক ভূমিকার সর্বোত্তম ও অর্থবহ অবস্থান আমরা কেবল আল-কুরআনেই খুঁজে পাই। কুরআন একজন নারীকে যে সম্মান প্রদান করেছে, তার তুলনা মানব ইতিহাসে আর কোথাও নেই। আর যেহেতু এই আলোকে নির্ধারিত নারীর অবস্থানই আমার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, তাই আমি মনে করি—“কুরআনিক সমাজে নারী” শিরোনামটিই সর্বাপেক্ষা যথার্থ ও সময়োপযোগী।
তৃতীয়ত,
আমি এই শিরোনামের মাধ্যমে জোর দিয়ে বলতে চাই—আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনকেই মূল দিকনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করা অপরিহার্য। এটি কেবল আমাদের ঈমান, আকীদা ও ইবাদতের জন্য জ্ঞানের উৎস নয়; বরং এটি সমগ্র ইসলামী সমাজব্যবস্থা ও উম্মাহর পথচলার জন্য এক পরিপূর্ণ হিদায়াত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল শতাব্দীগুলোতে পবিত্র কুরআনই ছিল মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূলভিত্তি, অর্থনৈতিক ন্যায়নীতির দিশারি, সামাজিক রূপরেখার স্থপতি এবং সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সৃজনশীলতার প্রধান চালিকাশক্তি। এর আলোয় মুসলিম জাতি আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার দিগন্ত প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
অতএব, আসন্ন দশক ও শতাব্দীতে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে একটি খাঁটি ইসলামী সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও কর্মপ্রবাহে পুনরায় সর্বব্যাপীভাবে কুরআনের আলো বিস্তার ঘটাতে হবে। ‘দ্বীন’ এমন একটি শব্দ, যা কেবল শাহাদাহ, সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ—এই পাঁচটি রুকনেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং ‘দ্বীন’ হলো এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার তাৎপর্য ইংরেজি ‘religion’ শব্দের সংকীর্ণ কাঠামোতে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দ্বীন আলোকিত করে মানুষের জীবনব্যবস্থার প্রতিটি দিক, প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি আচরণকে; এবং একে দেয় রূহানিয়াত, সভ্যতা ও পরিপূর্ণতা।
আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত জীবনের প্রতিটি কাজ ও অবস্থাকে দ্বীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। আর তা তখনই সম্ভব, যখন আমরা পবিত্র কুরআনকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পথনির্দেশক ও সংস্কারক রূপে গ্রহণ করব।
এই লক্ষ্য পূরণের অন্যতম কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে—কুরআন শরীফ আমাদের সমাজ গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে কী দিকনির্দেশনা দেয়, বিশেষত নারীর মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে কুরআনের বাণী কী বলে—তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করা।
একটি প্রকৃত কুরআনভিত্তিক সমাজের যে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো নারীর জীবনযাত্রা ও অধিকারকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে, তার মধ্যে পাঁচটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য এখানে আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হলো। এগুলো আলাদাভাবে বর্ণিত হলেও, প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই অপরটির সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত এবং পারস্পরিক সম্পর্কনির্ভর। তাই একটি বৈশিষ্ট্যকে অন্যটি ছাড়া সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
১. নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা
একটি কুরআনভিত্তিক সমাজের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান মর্যাদার অধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা। কুরআনের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষ উভয়েই আল্লাহর সৃষ্টি, এবং তাদের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও মানবিক মূল্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সমতার অর্থ এই নয় যে, তাদের শারীরিক কিংবা মানসিক গঠন অভিন্ন হতে হবে। বরং তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা বজায় রেখেই কুরআন তাদের মর্যাদাকে সমভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
নারী-পুরুষের এই সমমর্যাদা প্রসঙ্গে কুরআনে যুক্তিপূর্ণভাবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ক. ধর্মীয় দিক থেকে:
নারী-পুরুষ সমতার প্রাথমিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় মানবজাতির উৎস এবং ধর্মীয় কর্তব্য ও প্রতিদান প্রসঙ্গে উল্লিখিত কুরআনের বাণীতে।
১. মানব জাতির উৎস
কুরআনে এমন কোনো ধারণা নেই যা নারীর মর্যাদাকে খাটো করে। যেমন বাইবেলে বলা হয়েছে—নারী পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট, এবং হাওয়াকে (আঃ) পাপের মূল উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ আল-কুরআনে এ ধরনের কোনো বর্ণনা নেই। বরং কুরআন ঘোষণা করে:
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক প্রাণ (نَفْسٍ وَاحِدَةٍ) থেকে।”
— (সূরা নিসা, ৪:১; আরাফ, ৭:১৮৯)
এখানে নারী ও পুরুষ উভয়কেই পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা উভয়েই আল্লাহর খলিফা।
এছাড়া, আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-এর ভুল এবং তওবার ক্ষেত্রে কুরআন উভয়কেই সমানভাবে দায়ী করেছে। এবং আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা প্রার্থনার পর উভয়কেই ক্ষমা করেছেন।
২. ইবাদত ও পুরস্কার প্রসঙ্গে সমতা
কুরআনে নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর সমান দ্বীনি দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং পুরস্কারের ক্ষেত্রেও সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
“নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোজাদার পুরুষ ও রোজাদার নারী, লজ্জাস্থান সংরক্ষণকারী পুরুষ ও নারী, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী— তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”
— (সূরা আহযাব, ৩৩:৩৫)
খ. নৈতিক দায়িত্ব ও প্রতিদান:
কুরআনে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সমান নৈতিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং প্রতিদান ক্ষেত্রেও রয়েছে পূর্ণ সমতা।
“আর যে নেক কাজ করে—সে পুরুষ হোক কিংবা নারী—যদি সে মুমিন হয়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর তাদের প্রতি জাররা পরিমাণও জুলুম করা হবে না।”
— (সূরা নিসা, ৪:১২৪)
“যে নেক আমল করে—সে পুরুষ হোক কিংবা নারী—যদি সে মুমিন হয়, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং আমি তাকে তার আমলের সর্বোত্তম বিনিময় দান করব।”
— (সূরা নাহল, ১৬:৯৭)
এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান মর্যাদা ও মূল্য দিয়েছেন। তাঁরা উভয়েই পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে পাঠিত হয়েছেন।
গ. শিক্ষা:
যদিও নারী-পুরুষের সমান শিক্ষাগ্রহণের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নির্দেশনা হাদীসে পাওয়া যায়, তবুও কুরআনে সর্বজনীনভাবে জ্ঞানার্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে—যা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।
রাসূল সা. এর উপর অবতীর্ণ হওয়া কুরআনের প্রথম ওহীই ছিল:
“إقْرَأْ” – অর্থাৎ, “পড়ো!”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্য ফরজ।”
এমনকি তিনি (রাসূল সা.) দাসী মেয়েদেরও জ্ঞান শিক্ষা দিতে বলেছেন। এছাড়াও তিনি শিফা বিনতে আবদুল্লাহকে উনার সহধর্মিণী হাফসা (রাঃ)-কে জ্ঞান শিক্ষা দিতে বলেছিলেন। নবীর সময়কালে নারী-পুরুষ উভয়ই তার দারসে উপস্থিত থাকতেন এবং সাহাবিদের মধ্যেও অনেক বিদুষী নারী ছিলেন।
ঘ. আইনি মর্যাদা
কুরআন শরিফে নারী ও পুরুষের সমতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—উভয়ের জন্য সমান আইনি অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। পাশ্চাত্যের বহু সমাজে নারীরা একসময় স্বামীর অনুমতি ছাড়া নিজের সম্পদ রাখা, ক্রয়-বিক্রয় করা কিংবা চুক্তি সম্পাদন করতে পারত না। অথচ ইসলাম নারীদের এসব বিষয়ে প্রথম থেকেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। একজন নারী নিজের উপার্জন, সম্পদ, ক্রয়-বিক্রয় ও চুক্তি সম্পাদনের পূর্ণ অধিকার রাখেন। তিনি নিজের সম্পত্তি নিজেই ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। কুরআন এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেছে।
এছাড়া, ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকার (মীরাস) পাওয়ার অধিকার দিয়েছে (সূরা নিসা ৪:৭–১১), এবং কুরআনে এ অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে (৪:১৯)। একইভাবে, দেনমোহর (মোহরানা) একান্তভাবেই স্ত্রীর অধিকার; স্বামী তা নিজের করে নিতে পারে না—যতক্ষণ না স্ত্রী স্বেচ্ছায় তা উপহার দেন (২:২২৯; ৪:১৯–২১, ২৫; ৪:৪৪)।
তবে অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বও রয়েছে। যদি কোনো নারী অপরাধ করেন, তবে তার শাস্তিও হবে পুরুষের মতোই—না বেশি, না কম (৫:৪১; ২৪:২)। আবার যদি কোনো নারী অবিচার বা ক্ষতির শিকার হন, তবে তিনিও পুরুষের মতোই ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণের হকদার।
এসব প্রমাণ থেকে স্পষ্ট যে, কুরআন কেবল নারী-পুরুষ সমতার স্বীকৃতিই দেয়নি; বরং একে একটি আদর্শ ইসলামি সমাজের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই যারা বলে, ইসলাম নারীদের হেয় করে—তাদের দাবি কুরআনের আলোকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এমনকি যারা নারীদের নৈতিক, জ্ঞানগত কিংবা ধর্মীয়ভাবে পুরুষের চেয়ে নিচু মনে করে, তাদের ধারণাও কুরআন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে; যদিও অতীতের কিছু ধর্মে এমন ভুল বিশ্বাস প্রচলিত ছিল।
২. একলিঙ্গ নয়, দ্বৈত-লিঙ্গভিত্তিক সমাজব্যবস্থা
কুরআনভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দ্বিতীয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো—একলিঙ্গ সমাজের পরিবর্তে দ্বৈত-লিঙ্গভিত্তিক কাঠামোর স্বীকৃতি। নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কুরআন কখনোই এই সমতার দ্বারা তাদের অভিন্নতা বা পূর্ণ সাম্য বোঝায়নি।
আধুনিক যুগে আমরা ইউনিসেক্স পোশাক, অলংকার, চুলের ছাঁট এমনকি আচরণ ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও অভিন্নতার প্রবণতা লক্ষ্য করি। এমনকি অনেক পশ্চিমা সমাজে কারো দিকে তাকিয়ে বলা কঠিন হয়ে পড়ে—সে নারী না পুরুষ। এ প্রবণতা এমন একটি ভুল বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত, যেখানে বলা হয় নারী ও পুরুষের শারীরিক, মানসিক ও আবেগগত কাঠামোয় কোনো পার্থক্য নেই; তাই তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকার ভিন্নতাও থাকা উচিত নয়। নারীর অধিকারের দাবি জানাতে গিয়ে এ মতবাদ শেষমেশ নারীর স্বকীয়তাকে অবমূল্যায়িত করেছে। ফলে নারীরা পুরুষসত্তার অনুকরণে প্রবৃত্ত হতে গিয়ে নিজের প্রকৃত পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য হারাতে বসেছে। এর ফলাফল হয়েছে এক নতুন ধরনের আধুনিক পুরুষতন্ত্র, যা নারীর প্রকৃত অবস্থান ও মর্যাদাকে ধ্বংস করে।
এর বিপরীতে, কুরআনভিত্তিক সমাজ একটি দ্বৈত-লিঙ্গ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে—যেখানে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক কিন্তু পারস্পর-সম্পূরক দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। সমাজকে সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিচালনার স্বার্থে পুরুষদের উপর আর্থিক দায়িত্ব অধিকতর অর্পিত হয়েছে (সূরা বাকারা ২:২৩৩, ২৪০–২৪১; সূরা নিসা ৪:৩৪), আর নারীদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সন্তান ধারণ ও প্রতিপালনের দায়িত্বে (সূরা বাকারা ২:২৩৩; সূরা আরাফ ৭:১৮৯)।
এই দায়িত্বের ভারসাম্যের কারণে পুরুষদের উত্তরাধিকার অংশে তুলনামূলকভাবে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তবে নারীদের জীবিকাগত দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাদের ভরণপোষণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
অপরদিকে, ইউনিসেক্স মতবাদ সহযোগিতার বদলে নারী-পুরুষের মাঝে প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়—যা সমাজের প্রতিটি স্তরে অসুস্থতা ছড়ায়। এর বিপরীতে দ্বৈত-লিঙ্গভিত্তিক সমাজব্যবস্থা একটি স্বাভাবিক, পরীক্ষিত ও স্থিতিশীল কাঠামো, যা যুগে যুগে মানবসমাজকে ভারসাম্য ও স্থায়িত্ব দিয়েছে।
তাই মুসলমানদের কর্তব্য হলো, এই বিভ্রান্তিকর মতবাদের অন্তর্নিহিত বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজেদের সমাজ ও তরুণ প্রজন্মকে যথার্থ কুরআনিক আদর্শে গড়ে তোলা।
৩. সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
কুরআনিক সমাজের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো—সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর গুরুত্বারোপ। আধুনিক যুগে ব্যক্তি অধিকারের অতিরিক্ত জোর সমাজে সম্পর্কের শিথিলতা ও একাকীত্ব সৃষ্টি করেছে। অথচ কুরআন নারী ও পুরুষকে পারস্পরিক সম্পূরক ও নির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষা দিয়েছে।
কুরআনে স্বামী-স্ত্রীকে বলা হয়েছে একে অপরের “পোশাক” (সূরা আল-বাকারা ২:১৮৭)—যা আচ্ছাদন দেয়, সুরক্ষা করে ও প্রশান্তি আনে। আবার তাঁদের সম্পর্ককে শান্তি ও স্থিরতার উৎস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (সূরা আর-রূম ৩০:২১; সূরা আরাফ ৭:১৮৯)।
নারী ও পুরুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং একে অপরের অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে (সূরা আত-তাওবা ৯:৭১)। তাঁদের প্রত্যেকের নির্ধারিত দায়িত্ব কেবল পারস্পরিক নয়, বরং বৃহত্তর সমাজের কল্যাণ সাধনেও ভূমিকা রাখে।
এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে:
“ধর্মপরায়ণতা শুধু এই নয় যে, কোনো ব্যক্তি পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে ফিরে নামাজ আদায় করবে। বরং প্রকৃত ধর্মপরায়ণ সেই ব্যক্তি, যে ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামতের দিনে, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলের উপর; আর উপার্জিত ধনসম্পদ ব্যয় করবে আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতীম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী দাস-দাসীদের জন্য; নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দেবে; প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে এবং অভাব-অসুস্থতা ও যুদ্ধের সময়ে ধৈর্য ধারণ করবে। এরাই হলো সত্যাশ্রয়ী, এরাই হলো পরহেযগার।”
— (সূরা আল-বাকারা ২:১৭৭)
এইভাবে, কুরআন মুসলমানকে সমাজের অন্তর্ভুক্ত এক সদস্য হিসেবে দায়িত্ববান ও সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলে। এর ফলশ্রুতিতে একটি দৃঢ় সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়, যা মানুষের অন্তরে নিরাপত্তা ও প্রশান্তির অনুভূতি জাগায়।
এর বিপরীতে, পাশ্চাত্য সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে প্রবীণদের অবহেলা, প্রজন্মের ব্যবধান, আত্মহত্যার প্রবণতা এবং কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে—যা পারস্পরিক সমঝোতা ও নির্ভরশীলতার অভাবের পরিণতি।
৪. বর্ধিত পরিবার (Extended Family)
কুরআনভিত্তিক সমাজব্যবস্থার চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো—বর্ধিত পরিবারের প্রথা। ইসলামী পারিবারিক কাঠামো কেবল পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং দাদা-দাদি, নানা-নানী, চাচা-মামা, খালা-ফুফু ও তাঁদের সন্তানদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। এ ধরনের পরিবারকে বলা যায় এক দৃঢ় সামাজিক ইউনিট, যা আত্মীয়তার বন্ধনে গঠিত।
অধিকাংশ মুসলিম পরিবারকে বলা যায় “আবাসনভিত্তিকভাবে বিস্তৃত”—যেখানে বহু প্রজন্ম একই প্রাঙ্গণে বসবাস করে। আর একই ছাদের নিচে না থাকলেও আত্মীয়স্বজনদের সাথে দৃঢ় মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন বজায় থাকে।
এই বর্ধিত পারিবারিক কাঠামো পরিবারকে করে তোলে সহানুভূতিশীল, দায়িত্ববান এবং স্থিতিশীল। নারী-পুরুষের সম্পর্কও এতে হয় আরও পরিপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ। কুরআনে আত্মীয়স্বজনের হক, সদ্ব্যবহার এবং তাঁদের প্রতি দায়িত্ববোধের বিষয়ে বারবার বলা হয়েছে (দেখুন: সূরা বনি ইসরাইল ১৭:২৩–২৬; সূরা নিসা ৪:৭–৯; সূরা আনফাল ৮:৪১; সূরা নূর ২৪:২২; সূরা বাকারা ২:৮৩; সূরা নাহল ১৬:৯০)। এমনকি কুরআন বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের জন্যও নির্দিষ্টভাবে উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে (দেখুন: সূরা বাকারা ২:১৮০–১৮২; সূরা নিসা ৪:৩৩, ১৭৬)।
এই অধিকার ও দায়িত্ব অমান্যকারীদের জন্য কঠিন শাস্তির হুমকিও রয়েছে (সূরা নিসা ৪:৭–১২)। সুতরাং, বর্ধিত পরিবার কেবল একটি সামাজিক রীতিই নয় বরং এটি আল্লাহর প্রেরিত বাণীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠা একটি বৈধ ও আদর্শিক পারিবার কাঠামো।
এই কাঠামো পুরুষ ও নারীর জীবনে প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনে তখনই, যখন তা কুরআনিক সমাজের অন্যান্য মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে ওঠে। বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—
নিঃস্বার্থতা:
বর্ধিত পরিবার এমন একটি সামাজিক বলয় সৃষ্টি করে, যেখানে কেউ ভুল পথে গেলে শুধুমাত্র জীবনসঙ্গী নয়, বরং পুরো পরিবারের—সহপাঠী, জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠদের—মুখোমুখি হতে হয়। এতে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বেচ্ছাচার সহজেই নিয়ন্ত্রিত হয়, আর সমাজে নৈতিক শৃঙ্খলা দৃঢ় হয়।
নারীর কর্মজীবনে সহায়তা:
বর্ধিত পরিবার কর্মজীবী নারীর জন্য এক অনন্য সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলে। ঘরে অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য থাকায় মা ও স্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নারীরা নিশ্চিন্তে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হতে পারেন। এতে শারীরিক বা মানসিক বাড়তি চাপ পড়ে না, আবার সন্তানকে একা রেখে কাজ করার অপরাধবোধ থেকেও মুক্তি মেলে।
আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে একক পরিবারের কাঠামো নারীদের উপর যে বিরাট মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে—তার ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ও পরিবার ভাঙনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। এর ভয়াবহ সামাজিক প্রতিক্রিয়া এখন মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনজ্ঞদের জন্য গভীর চিন্তার কারণ।
সন্তানদের যথাযথ সামাজিকীকরণ:
ক্ষুদ্র পরিবারে সন্তানের অবাধ্যতা মায়ের বা বাবার একক নির্দেশে সহজে দমন হয় না। কিন্তু একটি সুসংগঠিত বর্ধিত পরিবারে সমষ্টিগত রীতি ও সামাজিক চাপ সন্তানের আচরণ সংশোধনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এতে শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার পরিবেশ তৈরি হয়।
সামাজিক ও মানসিক বিকাশ:
বর্ধিত পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়েই অন্যান্য সদস্যদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। ফলে শিশুরা হয় মুক্তমনা ও আত্মবিশ্বাসী, আর প্রবীণদের একাকীত্ব কাটে। দাম্পত্য জীবনে বিরোধ হলেও তা সহজে ভাঙনে গিয়ে পৌঁছায় না, কারণ সবসময় কেউ না কেউ পাশে থাকে—সান্ত্বনা দেয়, পরামর্শ দেয়, কিংবা কাঁধে মাথা রাখার মতো স্থান দেয়।
প্রজন্মগত ব্যবধানের সেতুবন্ধন:
‘আইলাহ’ কাঠামো প্রজন্মের ব্যবধানকে ঘনিষ্ঠতায় রূপ দেয়। আধুনিক সমাজে নবীন-প্রবীণদের মধ্যে যে জেনারেশন গ্যাপ সৃষ্টি হয়, বর্ধিত পরিবার তা পূরণ করে। তিন বা ততোধিক প্রজন্মের একসাথে বসবাস শিশুদের শেখা ও সামাজিক বিকাশ সহজ করে তোলে, আর প্রবীণদের দেয় স্নেহ ও মর্যাদা।
একাকীত্ব দূরীকরণ:
আধুনিক নগরজীবনে নিঃসঙ্গতা বিশেষত নারীদের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা। পাশ্চাত্যে অবিবাহিতা, তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা নারীরা ক্লাব, ডেটিং সাইট বা অবসরপ্রাপ্তদের নিবাসে একাকী জীবন কাটাতে বাধ্য হন। অথচ ইসলামী বর্ধিত পরিবারে তাদের স্থান, মর্যাদা ও ভালোবাসা নিশ্চিত থাকে। কুরআনিক সমাজে প্রত্যেক সদস্যের মানসিক ও সামাজিক প্রয়োজন পরিবার থেকেই পূরণ হয়।
বার্ধক্যে প্রবীণদের মর্যাদা:
একক পরিবারে প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার দায় প্রায়শই একজন নারীর কাঁধে এসে পড়ে। তিনি যদি কর্মজীবী হন, তবে পরিস্থিতি হয় আরও সংকটময়। অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু বর্ধিত পরিবারে এই দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে যায় সন্তান, ভাইবোন, মামা-চাচা ও অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে। ফলে প্রবীণরা পান যথাযোগ্য সম্মান, যত্ন ও পরিবারের উষ্ণ সান্নিধ্য।
৫. পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামো
কুরআনভিত্তিক সমাজের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো—পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামো। পাশ্চাত্যের নারীমুক্তি আন্দোলনের বিপরীতে, কুরআন এমন একটি সমাজ কাঠামোর নির্দেশ দেয়, যেখানে পরিবারের নেতৃত্ব ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পিত।
যেমন রাষ্ট্রনায়ক রাষ্ট্রের জন্য, বা একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কর্মীদের জন্য সিদ্ধান্ত নেন, তেমনি পরিবারেও প্রয়োজন একজন নেতৃত্বদানকারী। কুরআন এ দায়িত্ব দিয়েছে পুরুষকে, তবে আধিপত্যের জন্য নয়; বরং দায়িত্ব, রক্ষণাবেক্ষণ ও কল্যাণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে।
সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে:
“পুরুষরা নারীদের উপর দায়িত্বশীল, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে (নারীদের ভরণপোষণে)।”
এখানে ব্যবহৃত “কাওওয়ামুন” শব্দটির অর্থ কর্তৃত্ব নয়, বরং দায়িত্বশীলতা। কুরআন সচেতনভাবেই “মুসাইতিরুন” (নিয়ন্ত্রণকারী) বা “মুহাইমিনুন” (প্রভুত্বকারী) শব্দ ব্যবহার করেনি। অর্থাৎ নেতৃত্ব মানে আধিপত্য নয়, বরং দায়িত্ব গ্রহণ, সুরক্ষা ও সহানুভূতি।
কুরআনের সমালোচকেরা একে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ হিসেবে তুলে ধরতে চান, অথচ প্রকৃত অর্থে এটি পারিবারিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে এবং ভারসাম্য রক্ষার জন্য এক সংগঠিত ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা।
আজ যখন পাশ্চাত্য সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতা, ইউনিজেন্ডার আচরণ ও ক্ষুদ্র পরিবার কাঠামোর মোহে আবিষ্ট, তখন প্রমাণিত হচ্ছে—এসব মডেল ব্যর্থ। মুসলিম উম্মাহ যদি প্রকৃত কুরআনিক সমাজ গঠন না করে, বরং ছদ্ম-ইসলামিক কাঠামোতে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে মানুষ ভুল করেই সেটিকে ইসলাম মনে করবে। এতে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
তাই আমাদের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ব হলো কুরআনিক সমাজের প্রকৃত কাঠামো তুলে ধরা—যেখানে নারী, পরিবার ও সামাজিক সম্পর্কের নির্দেশনা সময়োপযোগী ও কার্যকর সমাধান হিসেবে বিরাজমান।
কারণ মুসলমানরা কেবল নিজেদের সমাজের জন্য নয়; বরং সমগ্র মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত হওয়ার জন্যই আল্লাহর খলিফা (২:৩০)। এই সময়টা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ—বিশ্বমানবতার সামনে কুরআনের সমাধান তুলে ধরার।
আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানবতার নাজাত ও কল্যাণের জন্য এর চেয়ে উত্তম খেদমত আর নেই। যুগের বিভ্রান্তি, নৈতিক অবক্ষয় ও আত্মিক শূন্যতার এই সন্ধিক্ষণে মানবতার প্রতি করুণা, হিকমাহ ও হেদায়তের হাত প্রসারিত করাই হবে প্রকৃত দাওয়াতের শ্রেষ্ঠতম রূপ।