বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত ভোগবাদী ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় “আভিজাত্য” শব্দটিকে অহংকার, বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে আভিজাত্যকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে কেবল পাশ্চাত্যচিন্তায় বিশ্বাসী ধনবান ভোগবাদী শ্রেণীর মধ্যে, যাদেরকে তথাকথিত এলিট বা অভিজাত শ্রেণী বলা হয়। সাধারণ মানুষও অন্ধভাবে এ শ্রেণীকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে। পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় হলো ধনসম্পদের মালিক হওয়া—সে সম্পদ যেভাবেই অর্জিত হোক না কেন; অন্যকে শোষণ করে, মানুষের সম্মান বিকিয়ে দিয়ে কিংবা অন্যায়পথে। উদ্দেশ্য একটাই—পাশ্চাত্য নির্ধারিত পুঁজিবাদী মানদণ্ডে নিজেকে এলিট শ্রেণীতে প্রতিষ্ঠিত করা।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আভিজাত্য এসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের ঊর্ধ্বে। আভিজাত্য আসমান ও জমিন উভয় অঙ্গনে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করে, আর অহংকার, বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারিতা মানুষকে আত্মিকভাবে হীন ও নীচ বানায়। অভিজাত বা আভিজাত্য শব্দগুলো আসলে নির্দেশ করে—মর্যাদাবান, বিজ্ঞ, উচ্চমানের চিন্তাশীল, উন্নত চরিত্রবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে।
আভিজাত্য দ্বীনে মুবীন ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য। সীরাতুন্নবী ﷺ আমাদের শিক্ষা দেয়—আভিজাত্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ।
অভিজাতের বিপরীত হলো নীচতা, অজ্ঞতা বা মূর্খতা। আমাদের মহান রব মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন—
- জ্ঞানার্জন করতে
- চিন্তা করতে
- চিন্তার মাধ্যমে হক অনুসন্ধান করতে
- এবং সত্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে
ইসলাম কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে বলেনি। বরং জ্ঞান ও চিন্তাশক্তিকে ব্যবহার করে হক অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঈমান স্থাপন করতে বলেছে। তাই ইসলাম মূর্খতা ও অন্ধত্বকে বর্জন করে সত্য ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে পৃথিবীকে গড়ে তুলতে আহ্বান জানায়। এটিই ইসলামী চিন্তায় আভিজাত্যের প্রকৃত স্বরূপ।
আখলাকের পূর্ণরূপই আভিজাত্য।
উন্নত চিন্তা, সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নন্দনতত্ত্ব এবং উত্তম বাকশৈলী—সবই আভিজাত্যের অন্তর্গত।
কথার আভিজাত্য: সত্য, সুন্দর, সুসংবাদপূর্ণ কথা বলা; মানুষের সম্মানের পরিপন্থী, মিথ্যা বা হতাশাজনক বাক্য পরিহার করা।
চিন্তার আভিজাত্য: কেবল ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বরং মানবতার কল্যাণ ও পৃথিবী বিনির্মাণে মগ্ন থাকা; মস্তিষ্ককে উন্নত চিন্তায় ব্যস্ত রাখা।
চারিত্রিক আভিজাত্য: তাকওয়ার মাধ্যমে অহংকার, হিংসা, ঘৃণা, স্বেচ্ছাচারিতা, দায়িত্বহীনতা ও স্বার্থপরতা থেকে আত্মাকে রক্ষা করা; হৃদয়কে ক্ষমা, রহম, মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ, সাহসিকতা, উদারতা ও হায়ার রঙে রাঙানো। চারিত্রিক আভিজাত্য হলো সর্বাবস্থায় অন্যের মঙ্গল কামনা করা।
উন্নত রুচিবোধ থেকেই জন্ম নেয় নন্দনতত্ত্ব। চিন্তা-চেতনা, আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান ও পরিবেশ—সবকিছুতেই এর প্রতিফলন ঘটতে হয়। রাসূল ﷺ বলেন:
“আল্লাহ সুন্দর, আর তিনি সৌন্দর্যকেই ভালোবাসেন।”
ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন, “শরীয়তের পাঁচটি মূল উদ্দেশ্যের একটি হলো মানুষের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা।” মানুষের সম্মান রক্ষার সাথে জড়িত গোপনীয়তা (Privacy) সংরক্ষণ। তাই সূরা হুজুরাতে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেন:
“তোমরা একে অপরের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না।”
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পর্দার বিধান। দুঃখজনকভাবে একে কেবল নারীর সাথে সম্পর্কিত করে সংকীর্ণ করা হয়েছে। অথচ পর্দা বিধানের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের সম্মান, মর্যাদা ও গোপনীয়তা রক্ষা। পাশ্চাত্য এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, বরং তারা এগুলোকে পণ্য বানিয়েছে। কিন্তু ইসলাম পর্দার বিধানের মাধ্যমে নফস থেকে শুরু করে সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মর্যাদা সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। রাসূল ﷺ এর সীরাতই এর সর্বোচ্চ উদাহরণ।
ইসলামের আভিজাত্য সম্পদ নির্ভর নয়; বরং তা নির্ভর করে মহান রবের আদেশ মানা ও তাকওয়ার উপর। অবশ্য ইসলাম হালালপন্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করে, তবে পাশ্চাত্যের সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো নয়—যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শোষণ করে অল্প কয়েকজন পুঁজির মালিক হয়। ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত ইহসান ও আদালতের উপর। যাকাত, সাদাকাহ ও ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম অর্থনীতিকেও আভিজাত্যের মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
অপরদিকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদে সবকিছু অর্থকেন্দ্রিক। তারা তথাকথিত এলিট শ্রেণীর প্রলোভন দেখিয়ে মানবপ্রকৃতি বা ফিতরাতকে ধ্বংস করছে, মানুষকে লজ্জাশীলতা বিসর্জন দিতে বাধ্য করছে। অথচ আভিজাত্য আমাদের রূহের বৈশিষ্ট্য, জান্নাতি মেহমানদের পরিচয়।
সুতরাং, একজন মুমিন হিসেবে আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে, ঈমানদার পরিচয় দেওয়ার মুহূর্ত থেকেই চিন্তা, বাক্য, আচরণ, পোশাক, বাসস্থান—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আভিজাত্যের ছাপ থাকা অপরিহার্য।
বাংলার মানুষ একসময় যে সুমহান সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেখানে মানুষের মর্যাদা ছিল সর্বাধিক, আমাদের নিয়্যত হোক সেই হারানো আভিজাত্য পুনরায় ধারণ করা। যেন উপমহাদেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের হক, সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সেই সুবাতাস।
ইনশাআল্লাহ, মহান রব আমাদের নিয়্যতের বরকতে আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করবেন, এবং আবারও সোনারগাঁও থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রবাহিত হবে আখলাক ও আদালতে ভরপুর শান্তির বারিধারা।
