“হে মানুষ সকল! আজ দয়াদ্রতা প্রদর্শনের দিন, আজ এমন দিন যেদিন আল্লাহ কুরাইশদেরকে সম্মানিত করবেন। আজ এমন দিন যেদিন রক্তপাতকে হারাম করেছেন।”
মক্কা বিজয়ের পর সমগ্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ অমর বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। সেদিন তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সর্বোত্তম আখলাকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। রাসূল ﷺ বলেছেন:
“আমি আখলাককে পরিপূর্ণতা দান করার জন্যই প্রেরিত হয়েছি।”
রাসূলের নবুওয়াতের পর থেকে প্রায় বারো শতাব্দী ইসলামি সভ্যতা দুনিয়াকে আখলাক, আদালত ও মারহামাতের আলোয় পরিচালিত করেছে। অথচ বর্তমান দুনিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখি—বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ সংকট বিরাজ করছে, তার মূলে রয়েছে আখলাকের অনুপস্থিতি।
আজ মুসলমানদের এ সংকটের পিছনে বহু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সেক্যুলার আখলাকের উত্থান, যেখানে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকে কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে মানুষ নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যে কোনো আচরণকে আখলাক হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে আমরা প্রত্যক্ষ করছি—
১. আখলাকবাদীতার নামে আখলাকবিহীনতার প্রসার।
২. দ্বীন ও আখলাকের মধ্যে কৃত্রিম বিভাজন।
এমনকি আজকের সমাজে দ্বীনদার ব্যক্তির আচরণেও আখলাকের ঘাটতি স্পষ্ট। এটি আসলে বৈশ্বিক আখলাকী সংকট, যা মানবতার সংকট হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।
এছাড়াও, আমরা সাধারণত আখলাক বলতে ভালো ব্যবহারকেই বুঝি। অথচ আখলাক কেবল ভালো ব্যবহার নয়; এর শাখা বিস্তৃত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—
জ্ঞানের আখলাক
আদালতের আখলাক
সভ্যতার আখলাক
পয়গামে মুহাম্মদীর আখলাক
কঠিন সময়ের আখলাক
জ্ঞান ও আখলাকের সম্পর্ক
একটি উদাহরণ ধরা যাক। একজন চিকিৎসক তার জ্ঞানকে রোগীর সেবার জন্য ব্যবহার করতে পারে, অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হিসেবেও কাজে লাগাতে পারে। আজ আমরা দেখি—বেশিরভাগ চিকিৎসক রোগীর সেবার চেয়ে রোগীর টাকার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। অথচ যদি তার জ্ঞানের সাথে আখলাক যুক্ত থাকত, তবে রোগীর কল্যাণই তার মূল লক্ষ্য হতো। তাই প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি দায়িত্বশীল ও আখলাকসম্পন্ন হয়।
সভ্যতার আখলাক ও বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ
আজকের বিশ্বায়নের যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি শান্তির বদলে যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও লালসার সেবা করছে। শক্তি, কামনা-বাসনা ও স্বার্থ মানুষের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে ভালো ও মন্দ, হক ও বাতিল, উপকারী ও অপকারীর স্থান পাল্টে গেছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক পদমর্যাদাকে জ্ঞানের মানদণ্ডে পরিণত করা। পদমর্যাদা ছাড়া কাউকে মানুষ জ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ প্রশ্ন হলো—এ প্রাতিষ্ঠানিক ধারা আদতে আখলাককে কতটুকু প্রভাবিত করছে? এজন্য আজ জ্ঞানের পাশাপাশি জ্ঞানের আখলাক নিয়ে চিন্তা করা জরুরি হয়ে গেছে।
আদালত, আখলাক ও আকল
আজ আমাদের কাছে রয়েছে কুরআন-হাদিস এবং প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। তারপরও মুসলিম উম্মাহর অবস্থা দুর্বল। কারণ মুসলিম দেশগুলোতে আদালত নেই। ইসলামের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যই ছিল দুনিয়ায় আদালত প্রতিষ্ঠা করা। তবে আদালত কেবল বিচারকার্য নয়; বরং এর সাথে আখলাক, মারহামাত, ইহসান ও আকলের সম্পর্ক রয়েছে।
আদালত দয়াদ্রতার চেয়ে বড় নয়, আবার শর্তহীন দয়াও আদালতের চেয়ে বড় নয়। প্রেক্ষাপট অনুযায়ী যেটি প্রাধান্য পাবে। তবে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইহসান আদালতের উপর প্রাধান্যশীল।
মরক্কোর দার্শনিক ত্বহা আবদুর রহমান বলেছেন:
“আখলাক হলো হুকুম আহকামের আকল।”
অর্থাৎ, আখলাক ছাড়া আইন ও বিধান প্রাণহীন হয়ে যায়।
ঈমান, ইবাদত ও আখলাক একত্রে
আমরা সাধারণত ঈমান, ইবাদত ও আখলাককে আলাদা স্তরে রাখি। অথচ এগুলো একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য। নামাজ মানুষকে পাপকাজ থেকে বিরত রাখার জন্য, রোজা তাকওয়া অর্জনের জন্য—কিন্তু এগুলো আখলাকের সাথে যুক্ত না হলে উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না।
আজ আমরা দেখি—
তাহাজ্জুদ আদায়কারী প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না।
নামাজ পড়া পিতা সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল নয়।
ইমাম ও আলেম সত্য গোপন করে, অন্যের হক নষ্ট করে।
এসবের কারণ হলো আখলাককে ইমান ও ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন করা। তাই এগুলোকে একত্রে রাখতে হবে।
কঠিন সময়ের আখলাক
বর্তমান সময় মানবতার জন্য কঠিন এক পরীক্ষা। এ সময় মুমিনের কর্তব্য হলো ধৈর্যধারণ, হতাশ না হওয়া এবং রবের কাছে দোয়া করা। কঠিন সময়ের আখলাক হলো ইসার—নিজের প্রয়োজনের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, দানশীল ও ক্ষমাশীল হওয়া।
ভিজ্যুয়াল সভ্যতা ও আখলাকের অবক্ষয়
আজ আমরা প্রবেশ করেছি এক স্ক্রিন-সভ্যতার যুগে। এখানে মানুষ বেশি দেখে, কিন্তু চিন্তা কম করে। আকলের ব্যবহার বন্ধ হয়ে সবাই নীরব দর্শকে পরিণত হচ্ছে। ফলে হৃদয় বা কলব মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
একে বলা হয় ভিজ্যুয়াল ইদরাক বা দৃষ্টিভিত্তিক উপলব্ধি। এর প্রভাবে সমাজে অশ্লীলতা, যৌনতার ব্যবসায়িকীকরণ, এবং নৈতিক মূল্যবোধের ধ্বংস ঘটছে। ফলে মানুষের চিন্তা ও স্বপ্ন থেকে হিকমত বা প্রজ্ঞা বিলীন হচ্ছে।
মুক্তির পথ: হায়া’র আখলাক
এই অবস্থা থেকে মুক্তির অন্যতম পথ হলো হায়া’র আখলাক। হায়া মানে কেবল লজ্জাশীলতা নয়; বরং হায়ার প্রকৃত অর্থ হলো হায়াত—সর্বক্ষণ আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করা।
“উনি আমাকে সবসময় দেখছেন”—এ চেতনা মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“ঈমান ও হায়া একে অপরের ভাই। যখন একটি চলে যায়, অন্যটিও চলে যায়।”
(সহীহ আল-বুখারী)
অতএব, ভিজ্যুয়াল ইদরাকের প্রলোভন থেকে মুক্তি পেতে এবং আখলাক পুনরুজ্জীবিত করতে সত্যিকারের হায়া অর্জন অপরিহার্য।
গ্রন্থসহায়িকা :
বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকট – প্রফেসর মেহমেদ গরমেজ
