হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন জ্ঞানের এক মহাসাগর, ওহীর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী, কোরআনের মুফাসসির এবং বহু হাদীসের রাবী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তার এই সকল গুণাবলী ও অবদান নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে শুধুমাত্র তাঁর বিবাহের বয়স অথবা মাযহাবগত দৃষ্টিকোন থেকে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
মূলত হযরত আয়েশা (রা.)-এর জীবনী ও তাঁর জ্ঞানভিত্তিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এখানে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোই তাঁর বিবাহের বয়স সম্পর্কে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে। তবে যেহেতু এই বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি বিতর্ক করা হয়ে থাকে, এজন্য আমি আমার গবেষণার আলোকে তাঁর বিবাহের বয়সের বিষয়টি তুলে ধরতে চাই।
হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিবাহের বয়সের বিষয়টি আজ বহু বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, অনেকে আবার এটাকে সমর্থন করে এটার স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন মতামতের অধিকারীরা তাদের মতের পক্ষে থাকা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, তা প্রকাশ করতে গিয়ে বিরোধী মতকে প্রায়ই ‘প্রতিরক্ষামূলক (Defensive) দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘ওরিয়েন্টালিস্টদের প্রভাবে গঠিত আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি’, অথবা ‘পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গি’ ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করে থাকেন। এধরণের দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে হযরত আয়েশার (রা.) বয়সের বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করার দাবী রাখে।
প্রথম কথা হচ্ছে যে, অন্য অনেকের মতই হাদীসের গ্রন্থসমূহে হযরত আয়েশার (রা.) জন্মতারিখ সম্পর্কেও নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারে অনেক আলেম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ ও ইতিহাসবিদ তাঁদের নিকট থাকা তথ্যের আলোকে হযরত আয়েশার (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহের বয়স সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পেশ করেছেন এবং প্রত্যেকে নিজ মতের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতেও ভুল করেননি। বিশেষ করে আধুনিক কালে হযরত আয়েশার (রা.) বিয়ের বয়স নিয়ে বহু প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ তাঁর অল্প বয়সে (৬–৯ বছর) বিবাহের বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, আবার কেউ কেউ বিদ্যমান প্রমাণের আলোকে বলেছেন যে, হযরত আয়েশা (রা.) আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর সঙ্গে অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
এই কারণে, হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিয়ের বয়স সম্পর্কিত মওজুদ মতামতগুলো সংক্ষেপে আরেকবার পর্যালোচনা করা যথাযথ হবে বলে মনে করি। এগুলোকে নিম্নরূপভাবে সাজানো যেতে পারে:
১। আরবের প্রথানুযায়ী কন্যাশিশুর বয়স গণনা শুরু হতো বালেগা হওয়ার পর থেকে:
এই বিষয়ে বিবেচনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আরবের প্রথানুযায়ী কন্যাশিশুর জন্মের বয়স ও বিয়ের বয়সকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা। খ্রিস্টান ধর্ম যাজকদের মধ্যে লুইস মা’লুফ তাঁর আল-মুনজিদ ফিল-লুগাতি ওয়াল-উলুম নামক অভিধানে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রা.) ৬০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন, ৬২৩ সালে হযরত নবী ﷺ-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ৬৯৬ সালে ইন্তেকাল করেন। অন্যান্য সূত্রের তুলনায় মা’লুফের অভিধানে হযরত আয়েশা (রা.)-এর মৃত্যুর সাল পরে, অর্থাৎ ৬৯৬ সাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মা’লুফ উল্লেখ করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রা.)-এর সাথে হযরত মুহাম্মাদ ﷺ-এর মক্কায় বাগদান হয়েছিল এবং হিজরতের ছয় মাস পর যখন তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল বিশ বছর। সূত্রে বলা হয়েছে, তখন হিজাজ অঞ্চলে এমন প্রথা ছিল যে, মেয়েদের বয়স গোনা শুরু হতো তারা বালেগা হওয়ার পর থেকে। এছাড়াও বলা হয়েছে যে, বালেগা হওয়ার বয়স ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে ধরা হতো। এছাড়াও মা’লুফের গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, সেই সময়ের আরবের প্রথা ও রীতি অনুযায়ী কন্যাশিশুদের কেবল বালেগা হওয়ার আগে জীবন্ত কবর দেওয়া যেত। বালেগা হওয়ার পর তাদের হত্যা করা প্রথাগতভাবে অনুমোদিত ছিল না। যদি বালেগা হওয়ার পর কোনো কন্যাশিশুকে হত্যা করা হতো, তবে তার পরিবারের দারুন-নদওয়ায় রক্তপণ বা ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করতে হতো। [1]
২। এই বিবাহের কারণে হযরত নবী ﷺ-এর প্রতি সমাজ থেকে কোনো সমালোচনা না আসা:
এটি সত্য যে, সমাজভেদে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রথা ও রীতিনীতিতে ভিন্নতা থাকে। বিবাহের ধরন, বিবাহের ধাপসমূহ, বিবাহ অনুষ্ঠান এবং পরিবার সদস্যদের দায়িত্বের মত সম্পর্কসমূহ এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে এমনকি একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের মধ্যেও ভিন্ন হতে পারে। বিবাহের বয়সও এসব বিষয়ের একটি, যা পরিবার গঠনকারী প্রতিটি সমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কাঠামোর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে। এই বাস্তবতা থেকে বোঝা যায় যে, হযরত পয়গাম্বর ﷺ যে সমাজে বসবাস করেছেন, সেই সমাজেরও নিজস্ব বিবাহের ধরন ও আচার-অনুষ্ঠান ছিল। একই সাথে যেখানে গড় আয়ু শুধুমাত্র চল্লিশ বছর, সেই সমাজে বংশধারা অব্যাহত রাখার জন্য অল্প বয়সে বিবাহ প্রায় এক প্রকার বাধ্যতামূলক ছিল। হযরত পয়গাম্বর ﷺ-ও এই সাংস্কৃতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। এটাও সত্য যে, হযরত পয়াগাম্বর ﷺ ও মুসলমানদের জীবনের ক্ষুদ্রতম বিষয়াবলীসমূহ পর্যন্ত সমাজ ও তাঁদের বিরোধীরা নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করত, আর যখন তারা সেই সমাজের প্রথা ও ঐতিহ্যের বিরোধী কোনো কাজ করতেন, তখন সমালোচনার সম্মুখীন হতেন। এখান থেকে বোঝা যায় যে, হযরত আয়েশার (রা.) বিবাহ যে বয়সেই হয়েছিল সেই বয়সে বিবাহের বিষয়টি সেই সমাজে স্বীকৃত একটি বিষয় ছিল।
৩। প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহনকারীদের মধ্যে তাঁর বড় বোন হযরত আসমার সাথে তাঁর নাম উল্লেখ থাকা:
এই পর্যবেক্ষণ আমাদের দেখায় যে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) সে সময় অল্প বয়সী হলেও নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতে সক্ষম এমন এক বয়সে ছিলেন এবং প্রথম দিকের মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মত উপযুক্ত অবস্থায় ছিলেন। উক্ত তথ্যগুলিতে হযরত আয়েশা (রা.)-কে উদ্দেশ্য করে ‘সে সময় তিনি ছোট ছিলেন’ — এমন একটি মন্তব্য সংযোজন করা হয়েছে, যা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোকে আরও সম্ভব করে তোলে।[2]
৪। তার বড় বোন আসমার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য:[3]
হযরত আবু বকর (রা.)-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা আসমা (রা.) হিজরতের ২৭ বছর আগে, অর্থাৎ ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। হিজরতের সময় আসমা (রা.)-এর বয়স ছিল ২৭ বছর এবং তিনি জুবাইর ইবন আওয়াম (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি হিজরি ৭৩ সালে ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে হযরত আসমা (রা.) এর বয়স হয়েছিল ১০০ বছর এবং হযরত আয়েশার সাথে তাঁর বয়সের পার্থক্য ছিল ১০ বছর। এই হিসেবে ১০ বছর পেছনে গেলে দেখা যায় যে, হিজরতের সময় হযরত আয়েশার বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। সেই হিসেবে বলা যায় যে, হিজরতের এক বছর পর যখন তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তাঁর বয়স ছিল কমপক্ষে ১৮-১৯ বছর।
৫। ইতোপূর্বে যুবাইর ইবনে মুত’ইমের সাথে বাগদত্তা থাকা :
হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিবাহের বয়স সম্পর্কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এর আগে তাঁর আরেকজনের সঙ্গে বাগদান হওয়া। ইতোপূর্বে তাঁর যুবাইর ইবনে মুত’ইমের সাথে বাগদান হওরার পর যুবাইর ইসলাম গ্রহণ করতে পারে এই ভয়ে তার মা এই বাগদান ভেঙে দেন। এখান থেকে বুঝা যায় যে, তিনি রিসালাতের পূর্বেই জন্মগ্রহন করেন।
৬। মাক্কী যুগ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচারণ :
মাক্কী যুগ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক বর্ণনাসমূহের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, নবুয়াত আসার অনেক আগেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর এই সকল বর্ণনায় উল্লেখ করেন যে, মক্কায় সবচেয়ে কঠিন সময়ে আল্লাহর রসূল সকাল-সন্ধ্যা তাদের বাড়িতে আসতেন। এই কঠিন সময়ে তাঁর পিতা হযরত আবু বকরের হাবশায় হিজরত করার চেষ্টা এবং তার বিস্তারিত বিবরণও তিনি তুলে ধরেছেন।[4] এছাড়াও হিজরত ও পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণসমূহও এই প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করার মতো বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত।
৭। মাক্কী আয়াতসমূহ সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা :
হযরত আয়েশা (রা.) একটি বর্ণনায় বলেন, “আমি যখন মক্কায় খেলাধুলাকারী একজন মেয়ে ছিলাম, তখন মুহাম্মাদ (স.) এর উপর ‘বরং ক্বিয়ামত হল (তাদের দুষ্কর্মের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য) তাদেরকে দেয়া নির্ধারিত সময়, ক্বিয়ামত অতি কঠিন, অতিশয় তিক্ত’।[5]—এই আয়াত নাজিল হয়েছিল।”[6] এই আয়াত সম্পূর্ণভাবে অবতীর্ণ হওয়া সূরা কামারের ৪৬ নম্বর আয়াত। এ সূরাটি ইবনে এরকামের বাড়িতে এবং রিসালাতের চতুর্থ, অষ্টম কিংবা নবম বছরে অবতীর্ণ হয়েছে—এমন ভিন্ন ভিন্ন রেওয়ায়েত পাওয়া যায়।[7] বিশেষ করে শাক্কুল কামার (চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া) এর ঘটনাকে বিবেচনায় নেওয়া কিছু আলেমের মতে, সূরাটি ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে নাজিল হয়েছিল। যদি এ তারিখকে ভিত্তি ধরা হয়, তাহলে বোঝা যায় যে, হযরত আয়েশা (রা.) নবুওয়্যত আসার অন্তত আট বছর আগে, অর্থাৎ ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭–১৮ বছর।
৮। নামাজ ফরজ হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা:
হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, নামাজ প্রথমে দুই রাকআত করে ফরজ করা হয়েছিল। পরে মুকীমদের জন্য তা চার রাকআতে বৃদ্ধি করা হয়, কিন্তু সফরের সময় আবার দুই রাকআতই রাখা হয়। এই বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, বিয়ের সময় তিনি পূর্ণ বয়স্কাই ছিলেন। কারণ তিনি এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
৯। তাঁর বয়স ও বিবাহ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতের ভিন্নতা:
এই বিষয়টি আজও এত বেশী আলোচনা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো—এ সম্পর্কে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলোর পারস্পরিক ভিন্নতা এবং সেগুলোর নিশ্চিত না হওয়া। কিছু রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, তাঁর বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় বয়স ছিল ছয় বা সাত বছর এবং বিবাহের সময় ছিল নয় বছর। তবে এসব বর্ণনাকে কেউ কেউ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন— “আমি বয়সের তুলনায় ছোট দেখাতাম।” অথবা “নবুওয়াত আসার সময় আমার বয়স ছয় বা সাত বছর ছিল।”
১০। উহুদের যুদ্ধে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণ:
উহহুদের যুদ্ধের সময় বয়স কম হওয়ার কারণে ছেলেদেরকেও যেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে হযরত আয়েশা (রা.) স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়েছিলেন।[8] বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, “উহুদের যুদ্ধে মুসলমানগণ অনেক বেশি পরিমাণে ক্ষতির সম্মুখীন হলে হযরত আয়েশা (রা.) ও উম্মে সুলাইম হাত ও পায়ের কাপড় গুটিয়ে আহত সাহাবীদের জন্য কাঁধে করে মশক ভর্তি পানি বহন করেছেন।”[9] সমাজে অল্প বয়সে বিয়ের প্রচলন থাকলেও, ৮-৯ বছর বয়সের একটি কন্যাশিশুর যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করা যে বাস্তবসম্মত নয়, তা স্পষ্ট।
১১। ইফক এর ঘটনার সময় তাঁর প্রদর্শিত পরিপক্ব আচরণ:
ইফকের ঘটনার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন আয়াত নাযিল করে তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করেন তখন তিনি বলেছিলেন, —“আমার নির্দোষিতা স্বয়ং আল্লাহ প্রকাশ করেছেন। সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা শুধু তাঁর জন্যই।” —এমন দৃঢ় ও পরিপক্ব আচরণ যতই ব্যতিক্রমী হোক না কেন, একটি ছোট কন্যাশিশুর পক্ষে প্রদর্শন করা সম্ভব নয়।
১২। কুরআন, হাদীস এবং জ্ঞানগত বিষয়ে গভীরতা:
হযরত আয়েশা (রা.) ওহীর স্বাক্ষী ছিলেন, অনেক আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতেন এবং স্বয়ং নিজে অনেক আয়াত নাযিলের কারণও হয়েছেন। তিনি কুরআনের কিছু আয়াত স্বয়ং তাফসির করেছেন, এবং কোনো অসম্পূর্ণ বা ভুল রেওয়ায়েত শুনলে কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণ এনে তা সংশোধন করেছেন। তিনি তাঁর জ্ঞান, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ফিকহী মতামতের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে স্বতন্ত্র মর্যাদা অর্জন করেছেন। এসব বৈশিষ্ট্য কোন শিশুর পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়; বরং একজন পরিণত বয়সের ব্যক্তির পক্ষেই কেবল অর্জন করা সম্ভব।
১৩। তাঁর ওফাত সম্পর্কিত রেওয়ায়েতসমূহ:
এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় সেই রেওয়ায়েতে, যেখানে বলা হয়েছে—হযরত আয়েশা (রা.) হিজরি ৫৮ সালে এবং ৭৪ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। এই রেওয়ায়েত অনুযায়ী, তিনি রমজান মাসের ১৭ তারিখের বুধবার রাতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর ওসিয়ত অনুযায়ী তাঁর জানাজা নামাজে ইমামতি করেন আবু হুরাইরা (রা.) এবং বেতরের নামাজের পর রাতেই তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।[10] এভাবে বিস্তারিত বিবরণ থাকার কারণে এই রেওয়ায়েতকে অন্যান্যগুলোর তুলনায় অধিক শক্তিশালী ধরা হয়।
সর্বোপরি, তাঁর বড় বোন আসমা ও ভাই আবদুর রহমানের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য, পূর্বে জুবাইর ইবনে মুতইম-এর সঙ্গে বাগদান হওয়া, প্রথম দিকের মুসলমানদের মধ্যে বোন আসমার সঙ্গে তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া, মাক্কী যুগ সম্পর্কিত তাঁর স্মৃতিচারণমূলক বর্ণনা, মাক্কী আয়াত সম্পর্কে তাঁর রেওয়ায়েত, নামাজ ফরজ হওয়ার বিষয়ে তাঁর বর্ণনা, বয়স ও বিবাহ সংক্রান্ত খবরের ভিন্নতা, উহুদ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, ইফক এর ঘটনার সময় তাঁর প্রদর্শিত পরিপক্ব আচরণ, কুরআন-হাদিস ও জ্ঞানগত বিষয়ে তাঁর প্রাজ্ঞতা, এই বিবাহের কারণে সমাজ থেকে মুহাম্মদ (সা.) কোনো ধরণের সমালোচনার মুখোমুখি না হওয়া, বুখারীর আলোচ্য রেওয়ায়েতের আরব প্রথায় মেয়েদের বয়স বালেগ হওয়ার পর থেকে গণনার কারণে ভিন্নতা এবং ওফাতের তারিখ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ সহ— সকল কিছুকে একসঙ্গে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, তাঁর ছয় বছর বয়সে বাগদান এবং নয় বছর বয়সে বিবাহ হওয়া সম্ভব নয়; বরং বিবাহের সময় তিনি উম্মতের জননী হওয়ার উপযুক্ত বয়সে ছিলেন। গবেষক উমর রেজা দরুল গবেষণা করে বহু দলীলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রা.) যখন নবী করিমের (সা.) সঙ্গে বিবাহে বন্ধনে আবদ্ধ হোন তখন ৭ বা ৯ নয়, অন্তত ১৭-১৮ বছর বয়সী ছিলেন।[11]
তবে এখানে এই বিষয়টিও মনে রাখা দরকার যে, হযরত আয়েশা (রা.)- এর বিবাহের বয়স নিয়ে যে মন্তব্য ও প্রমাণ রয়েছে তার মধ্যে কোন মতটি সঠিক সেটা আসলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভবপর নয়। কেননা এসকল কিছু ঐতিহাসিক তথ্য এবং রেওয়ায়েতকে ইতিহাসভিত্তিক পাঠের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে। একারণে এর যে কোন একটিকে বেছে নিতে হবে। এই দৃষ্টিকোন থেকে রেওয়ায়েত ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন থেকে আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিবাহের বয়স প্রায় ১৭-১৮ বছর হওয়ার ধারণাটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। আমিও এই মতের পক্ষে।
[1] লুইস মা’লুফ, আল মুনজিদ ফিল লুগাতি ওয়াল উলুম, পৃষ্ঠা, ৩৩১ ।
[2] ইবনে হিশাম, সিরাত, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ২৭১।
[3] ইবনে সা’দ, তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ৫৮।
[4] Savaş, “Hz. Aişe’nin Evlenme Yaşı ile İlgili Farklı Bir Yaklaşım”, s. . 140-141.
[5] সূরা ক্বামার, ৪৬।
[6] বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ বুখারী, ফাদয়িলুল-কুরআন ৬; তাফসীরুস সূরা (৫৪) ৬; আয়নী, বদরুদ্দীন আবু মুহাম্মদ মাহমূদ ইবন আহমদ, উমদাতুল কারী শারহু সহীহিল বুখারী, খণ্ড ২০, পৃষ্ঠা ২১।
[7] আবুল ফযল জালালুদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর আস সুয়ুতী , আল-ইতকান ফি উলূমিল কুরআন, (বৈরুত: দারুল-কুতুবুল-ইলমিয়্যাহ, ১৯৮৭), খণ্ড ১, পৃ. ২৯, ৫০।
[8] বুখারী, জিহাদ, ৬৫।
[9] বুখারী, জিহাদ, ৬৪; মুসলিম জিহাদ, জিহাদ, ১৩৬।
[10] ইবনে আব্দুল বার, ইস্তিয়াব, II, ১০৮।
[11] বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন.: Doğrul, Asr-ı Saadet, II. 141, 147-151.