সাহিত্য চর্চায় ইসলামের প্রেরণা এবং কিছু ঘটনা

সাহিত্য ও সংস্কৃতি

যারা সংস্কৃতি চর্চা করেন, লেখালেখি করেন, কাব্য চর্চা বা গল্প উপন্যাস লেখেন, তাদের সম্পর্কে আমাদের সমাজে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। স্বাভাবিক কারণেই নতুন ও প্রতিভাবান লেখক এবং শিল্পীরা এতে নিরুৎসাহিত হন। অনেকে এমনও বলেন, কবি বা সাহিত্যিকরা যা লেখেন তা তাদের কল্পনা থেকে লেখেন। কল্পনা কখনো বাস্তব নয়। কল্পনা করে তারা যা লেখেন হুবহু সেই ঘটনাটি হয়তো কখনো ঘটেইনি। ফলে কল্পনা করে যা বলা হয় তা এক ধরনের মিথ্যাচার। কোন মুসলমান মিথ্যা বলতে পারে না, মিথ্যাকে প্রশ্রয়ও দিতে পারে না।

এই নেতিবাচক মনোভাবটি যখন কোন আলেম প্রকাশ করেন তখন শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটি দেখা দেয়, তাহলে কি ইসলাম সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকে নিরুৎসাহিত করে? প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর। মনগড়া যুক্তির পরিবর্তে এর মীমাংসার জন্য আমাদের কুরআন এবং হাদীসের কাছেই ফিরে যাওয়া উচিত। কারণ কুরআন এবং হাদীসই হচ্ছে আমাদের মূল গাইড। ইসলামের মূল দর্শন কুরআন ও হাদীস থেকেই নিতে হবে। কুরআন ও হাদীসই আমাদের যে কোন সমস্যা ও যে কোন প্রশ্ন সমাধানের চূড়ান্ত পথ ও দিকনির্দেশক। ফলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা জায়েজ কিনা, জায়েজ হলে তার সীমারেখা কতটুকু, ইসলাম সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকে কতটা গুরুত্ব দেয়- এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে কোন আয়াত নাজিল হয়েছে কিনা, হাদীসে এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য এসেছে কিনা, এসে থাকলে তাতে কি বলা হয়েছে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করতে পারলে এ ক্ষেত্রে কোন বিভ্রান্তি আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে পারবে না। প্রথমেই জেনে নেয়া দরকার, কালামে পাকে সাহিত্য প্রসঙ্গে একটি দুটি নয়, অসংখ্য দিক নির্দেশনা এসেছে। একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে (আশ শুয়ারা) ‘কবি’ নামে, বিষয়টির গুরুত্ব বুঝানোর এবং কবিদের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য। কুরআনের এই সূরার শেষের দিকের চারটি আয়াতে সাহিত্যের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অতএব সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি কোন হেলাফেলার বিষয় নয়।স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকে গুরুত্ব দিয়ে কুরআনে আয়াত নাযিল করেছেন, কোন মুসলমান তাকে গুরুত্বহীন মনে করতে পারে না।

এবার কুরআনের সূরা আশ শোয়ারা এবং শিল্প সাহিত্য আয়াতে কি বলা হয়েছে এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে আমরা সেদিকে মনোযোগী হবো। কবিদের সম্পর্কে সূরা আশ শোয়ারার একটি আয়াত খুবই মশহর। তাতে বলা হয়েছে: ‘এবং কবিদের অনুসরণ করে তারা যারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখ না যে, তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ২২৪-২৭)। এক শ্রেণীর অল্পশিক্ষিত আলেম ও সাধারণ মানুষ আয়াতের প্রথম অংশ পড়ে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েন যে, তারা আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তারা বলে ওঠেন দেখলে, আল্লাহ কবিদের কেমন অপছন্দ করেন? তিনি তাদেরকে বিভ্রান্ত উপত্যকার অধিবাসী বলে তিরস্কার করেছেন এবং তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। এসব ব্যক্তি যদি আরো একটু ধৈর্য ধরে আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়তেন তবে তারা দেখতে পেতেন, ‘তবে তারা ছাড়া’ বলে আয়াতের শেষাংশে আরেকদল কবির উল্লেখ করেছেন, যাঁরা আল্লাহর অপছন্দনীয় তো নয়ই, বরং আল্লাহর বিশেষ কৃপাধন্য। এসব কবির করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ সরাসরি গাইড ও নির্দেশনা দিয়েছেন উক্ত আয়াতে। আল্লাহর নির্দেশনা ও গাইড যারা মেনে চলে তারাই তো যথার্থ ঈমানদার এবং এ ধরনের লোকদের সাফল্য নিশ্চিত। আয়াতের শেষাংশে কবিদের জন্য কতিপয় নির্দেশনা ও মহৎ গুণাবলীর উল্লেখ করে আল্লাহ মানব সমাজে এসব কবির শ্রেষ্ঠত্বই তুলে ধরেছেন। আল্লাহর উল্লিখিত গুণাবলী যেসব কবির মধ্যে থাকবে তারা আল্লাহর পছন্দনীয় ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর পছন্দের তালিকায় উঠে যায় তবে সারা দুনিয়া তাকে অপছন্দ করলেও কিছু যায় আসে না। কবিদেরকে আল্লাহর অপছন্দের তালিকা থেকে পছন্দের তালিকায় উঠে আসার জন্য আল্লাহ বেশি কিছু করতে বলেননি। কবিদেরকে বলেছেন মাত্র চারটি গুণ অর্জন করতে। যদি কোন কবি এ চারটি গুণ অর্জন করতে পারে, তবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার সাফল্য অবধারিত। পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই যে তার সেই সাফল্য ছিনিয়ে নিতে পারে। এ গুণ চারটি কি? আল্লাহ বলেন, সে চারটি গুণ হচ্ছে:

‘(১) যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, (২) সৎকর্ম করে, (৩) আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং (৪) নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ২২৭)।

পবিত্র কালামের এ আয়াতে যে বক্তব্য এসেছে তা বুঝতে হলে কি পদ্ধতিতে ইসলাম তার বক্তব্য উপস্থাপন করে সেদিকে একটু নজর দেয়া দরকার। এটা কুরআনের বক্তব্য উপস্থাপনের একটি বিশেষ টেকনিক। এ টেকনিকটি হচ্ছে, ইসলাম কোন একটি বিষয়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রথমে তার নেতিবাচক এবং পরে তার সাথে সঙ্গতি রেখে ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরে। যেমন ইসলাম বলে ‘লা-ইলাহা’- ‘কোন ইলাহ নেই’, ‘ইল্লাল্লাহ’- ‘আল্লাহ ছাড়া’। এখানে মূল আলোচ্য বিষয় আল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। এ বাক্যের প্রথম অংশের কোন মূল্য নেই দ্বিতীয় অংশ ছাড়া। দ্বিতীয় অংশটির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রথম অংশটির অবতারণা করা হয়েছে। কবিদের অনুসরণ করে যারা তারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখ না যে, তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ এখানে আল্লাহ ঈমানদার কবিদের মর্যাদা ও গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রথমে মুশরিক কবিদের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের পরিচিতি তুলে ধরে বলেছেন: ‘তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না।’ এ বক্তব্যটি বলার পর কোন রকম বিরতি ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন: ‘তবে তারা ছাড়া, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ বস্তুত এরাই হচ্ছে আল্লাহর পছন্দনীয় কবি, যাদেরকে আল্লাহ মানবতার কল্যাণের জন্য কাব্য চর্চার বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।

নেতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রসঙ্গ উজ্জ্বলতর করার কুরানিক এ বৈশিষ্ট উপলব্ধি করার অক্ষমতার কারণে এ আয়াত ব্যবহার করে কেউ কেউ কবিদের মর্যাদাহীন করতে চেয়েছেন। কিন্তু কুরানিক বৈশিষ্ট উপলব্ধি করতে পারলে ইসলাম সাহিত্য চর্চাকে কতটা গুরুত্ব দেয় এবং কবিদের কত উচ্চ মর্যাদা দেয় তা তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন। কুরআনের প্রায় সকল তাফসীরকারই একমত যে, এ আয়াতের মাধ্যমে সাহিত্য চর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি বরং ঈমানদার কবিদেরকে গাইডলাইন দিয়ে তাদের কাব্য চর্চাকে আরো উৎসাহিত করা হয়েছে।

তাফসীরকারগণ আরো বলেছেন, “আয়াতের প্রথমাংশে মুশরিক কবিদেরকে বুঝানো হয়েছে।” বস্তুত এ আয়াতের মাধ্যমে একদিকে বিপথগামী কবিদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ঈমানদার কবিদের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করা হয়েছে। এতে করে ঈমানদার কবিগণ তাদের কাব্য চর্চা যে নিরর্থক নয় এ ব্যাপারে সন্দেহাতীত হয়েছেন এবং আল্লাহর দেয়া গাইডলাইন মোতাবিক কাব্য চর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত হয়েছেন।

এবার এ আয়াতের আরো একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। আল্লাহ বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন প্রকার স্বভাব, প্রকৃতি ও গুণ দিয়ে ভূষিত করেছেন। আল্লাহর দেয়া এ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা মানুষের সাধ্যের অতীত। যারা কবি তারা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ ও আবেগী। এটা তাদের স্বভাবধর্ম। এ কল্পনাপ্রবণতা না থাকলে কাব্য হবে কিভাবে? এ কল্পনাপ্রবণতা কবিদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত, যে নেয়ামতের কারণে সাধারণ মানুষ যা পারে না তারা তা পারেন, আর পারেন বলেই তারা কবি। কবিদেরকে এ ভাবের জগৎ থেকে, কল্পনাপ্রবণতা থেকে দূরে রাখা আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। তবে তারা যেন ভাবের জগতে বিচরণ করতে গিয়ে জগত সংসার ভুলে না যান, সেদিকটিও দেখতে হবে। এজন্যই আল্লাহ কোথাও কবিদেরকে ভাবের জগত থেকে বেরিয়ে আসতে বলেননি, কিন্তু এমন কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন যাতে তারা সীমালঙ্ঘনকারী হতে না পারেন। আল্লাহর বর্ণনাভঙ্গি কত চমৎকার ও তাৎপর্যমণ্ডিত। আল্লাহ বলছেন, ‘তুমি কি দেখ না যে তারা (কবিরা) প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ এ আয়াতের তাৎপর্যময় অংশ হচ্ছে ‘তবে তাদের কথা আলাদা’ অংশটুকু। সংযোজিত অংশটির মাধ্যমে আল্লাহ উভয় অংশের মধ্যে এমন একটি সংযোগ-সেতু স্থাপন করেছেন যা অতুলনীয় বাকচাতুর্যে পরিপূর্ণ। কবিসত্তার অধিকারী একজন মানুষকে আল্লাহ জানাচ্ছেন, যদি সে তার এ কবি স্বভাবের সাথে চারটি মাত্র গুণ আয়ত্ত করে নিতে পারে তাহলেই সে আল্লাহর পছন্দনীয় ও প্রিয়ভাজনদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে। এ গুণ চারটি হচ্ছে, ঈমান আনা, সৎকর্ম করা, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে একজন ঈমানদার কবির কি কি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

১. একজন কবি ঈমানদার কবিদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে প্রথমেই তাকে ঈমান আনতে হবে।

২. ঈমান আনার পর সে আর অসৎ কর্মে লিপ্ত হবে না।

৩. তার ভাবপ্রবণতা যেন তাকে বিপথগামী করতে না পারে সেজন্য সে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে।

৪. আর নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে।

এ আয়াতে উল্লিখিত প্রথম ও দ্বিতীয় গুণ দুটো কবির ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পর্কিত। তৃতীয় ও চতুর্থ গুণ দুটোর সম্পর্ক তার কাব্য ও শিল্পসত্তার সাথে। এখানে একজন কবি বা সাহিত্যিককে আল্লাহ ভাবপ্রবণতা বর্জন করার হুকুম না দিয়ে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করার মাধ্যমে তাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে বলেছেন। এতে করে তার বিপথগামী হওয়ার ভয় যেমন তিরোহিত হবে তেমনি কাব্য বা শিল্প চর্চা থেকেও তাকে সরে দাঁড়াতে হবে না। এর মধ্য দিয়ে কবিদের প্রতি আল্লাহর এক ধরনের স্নেহময় প্রশ্রয়তা লক্ষ্য করা যায়।

এই সংগে বিভ্রান্ত করিয়া যে দোষে দুষ্ট তা থেকে আত্মরক্ষা করাও বিশ্বাসী কবিদের গুণের অন্তর্গত হতে পারে। যেমন এক, বিভিন্ন ভুল পথে ছুটাছুটি না করে রব নির্ধারিত সিরাতুল মুস্তাকিমের সরল সহজ পথে অবস্থান করা। দুই, মুনাফেকী চরিত্র বর্জন করা এবং যা করবোনা তা না বলা। এদুটি মুমিন কবিদের গুণে পরিণত হতে পারে।

সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা মহানবী (স.)-এর সুন্নত

কুরআন ইসলামী সাহিত্য চর্চাকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে সংক্ষেপে আমরা তা আলোচনা করেছি। ইসলামের তাত্ত্বিক দিকটি আমরা কুরআন থেকে জানতে পারলেও তার প্রায়োগিক দিকটি বুঝতে হয় হাদীস থেকে। হাদীস ইসলামী জ্ঞান চর্চার দ্বিতীয় উৎস। রসূল স. যা করেছেন, করতে বলেছেন, করার জন্য অনুমোদন করেছেন তা সবই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের ৮২ জায়গায় নামাজের প্রসঙ্গ এসেছে। তা থেকে আমরা নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহিত হয়েছি। কিন্তু নামাজ পড়ার নিয়ম বা পদ্ধতিটি আমরা শিখেছি রসূলের জীবন থেকে। নামাজের ওয়াক্ত, রুকু, সিজদাসহ কিভাবে নামাজ পড়তে হবে তার সব কিছুই আমরা শিখেছি রসূলের জীবন থেকে। আর রসূলের জীবনধারা সংরক্ষিত আছে হাদীসে। এ জন্যই সুন্নাহ তথা হাদীসকে বলা হয় জীবন্ত কুরআন। শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপারে রসূল স. কি ভাবতেন, এ ব্যাপারে তিনি কি করেছেন এবং করতে বলেছেন তা সবই হাদীসে লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে সেই জীবনধারা পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে আমাদের কর্তব্য ও কর্মসূচী নির্ধারণ করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, কবি ও কবিতার জন্য ভূবনখ্যাত এক জনপদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। দু’একটি খণ্ড কবিতা বা কবিতার লাইন এঁড়া তিনি। যদিও কোন কবিতা রচনা করেননি কিন্তু তাঁর আম্মা আমেনা বিনতে ওয়াহাব ছিলেন যুগধর্মের দাবীতে একজন স্বভাব কবি। রসূল স.-এর পিতা আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের আকস্মিক মৃত্যুর পর তিনি যে মর্সিয়া বা শোকগাথা গেয়ে রোনাজারি করেছিলেন তা ইতিহাসখ্যাত। রসূল স.-এর জন্মের আগে বিবি আমেনা জগৎখ্যাত এক শিশুর জন্মের বিষয়ে প্রায়ই স্বপ্নাদিষ্ট হতেন। এ ভাবাবেগেও তিনি বেশ কিছু খণ্ড কবিতা রচনা করেন। তাঁর পিতৃব্য আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিবেরও কবিখ্যাতি ছিল সুবিদিত। অর্থাৎ আমাদের নবীর জন্মই হয়েছিল এক কবি পরিবারে।

নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই রসূলে খোদার স. মধ্যে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ওপর একটি অসাধারণ দখল এসে গিয়েছিল প্রকৃতিগতভাবে একজন আরব হবার কারণে। এ ছাড়া ভাষার গতি ও লাবণ্যের প্রতি তাঁর একটি স্বভাব সুলভ কৌতূহলও ছিল। একবার হযরত ওমর রা. রসূল স.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে বড় হলেন অথচ আপনি কথা বলেন আমাদের চেয়ে সুন্দর ভাষায়।’ অন্যান্য সাহাবীও তাঁর সুমধুর বাচনভঙ্গির প্রশংসা করতেন। উত্তরে তিনি বলতেন, ‘এতো আমার অধিকার, কারণ কুরআন তো আরবী মবীন ভাষায় আমার কাছেই নাযিল হয়েছে।’ এভাবেই আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে সাহিত্যের এক সৌরভময় ভুবনে প্রেরণ করেছিলেন।

কবি ও কবিতার প্রতি ভালোবাসা

তাঁর জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি, কবিতার প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব দরদ ও অনুরাগ। তিনি কবিতা পছন্দ করতেন, কবিদেরকে ভালোবাসতেন। কবি ও কবিতার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ছিলেন উদারহস্ত। কবিদের যে সম্মান ও মর্যাদা তিনি দিয়েছেন তা ছিল তুলনারহিত। তিনি কেমন কাব্যপ্রেমিক ছিলেন সে প্রসঙ্গে দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

সাহাবী শারীদ রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগে কোন বাহনের পিঠে সওয়ার ছিলাম। এমন সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উমাইয়া ইবনে আবী সালতের কোন কবিতা কি তোমার মনে আছে?’ (উল্লেখ্য উমাইয়া ইবনে আবী সাল্ভ জাহেলী যুগের বড় কবি ছিলেন এবং জাহেলিয়াতের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।) রসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের জবাবে শারীদ রা. জবাব দেন, ‘হ্যাঁ মনে আছে।’ তিনি বললেন, ‘পড়!’ শারিদ (রা) বলেন, ‘আমি একটি কবিতা পড়ে থামলে তিনি বললেন, ‘আরো পড়!’ ‘এভাবে আমি তার একশ’টি কবিতা পড়লাম।’

হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, রসূল স. প্রখ্যাত মহিলা কবি খানসা রা.-এর কবিতা ব্রেশ পছন্দ করতেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল শ্রুতিমধুর এবং তিনি চার শহীদের জননী ছিলেন। মাঝে মাঝে রসূল স. তাঁর কবিতা শুনতে চাইতেন এবং হাত ইশারা করে বলতেন, ‘খান্‌সা, আরও শোনাও’। রসূলের কাব্যপ্রেমের অনেক ঘটনাই হাদীস শরীফের অংশ হয়ে আছে। তেমনি একটি ঘটনা, রসূল স. দীর্ঘ সফরে বের হয়েছেন। মরুপথে উট চলছে। রাতও হয়েছে বেশ। রসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হাসান কোথায়?’ হযরত হাসান বিন সাবিত রা. এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ্! এই তো আমি।’ মহানবী স. বললেন, ‘আমাদের কিছু ‘হুদী’ শুনাও তো।’ শুরু করলেন কবি। ওদিকে মহানবী স. শুনছেন। উটও চলছে অধিকতর ক্ষিপ্রতায়। উটের দ্রুত চলার কারণে মনে হচ্ছে হাওদা যেনো পেছন দিকে ভেঙে পড়ে যাবে। থামতে বললেন মহানবী স.। আর মন্তব্য করলেন, ‘এ জন্যই কবিতাকে বলা হয় বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং এর আঘাত শেলের আঘাতের চেয়েও ক্ষিপ্র ও ভয়ানক।’ কবিতার ক্ষমতা সম্পর্কে কি অসাধারণ মূল্যায়ন!

কবিতা ছিল তৎকালীন মুসলমানদের শোক-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার প্রতিটি মুহূর্তের নিত্যসঙ্গী। শোকে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় রসূল স.-কে স্ফূর্তিতে রাখার জন্য সাহাবী কবিরা সব সময়ই তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। মক্কা বিজয়ের সময়ের কথা স্মরণ করুন। রসূল স. বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করছেন : আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা রা. উটের লাগাম ধরে হাঁটছেন আর গাইছেনঃ

‘কাফির বংশ, শোনরে ওরে পথ ছেড়ে দে

সকল ভালো রসূল মাঝে, নে লুটে নে।’

মুসলমানরা কুবার মসজিদ বানাতে ব্যস্ত। মহানবীও আছেন তাঁদের সাথে।তারা কাজ করছেন আর সমস্বরে ইবনে রাওয়াহার রা. কবিতা আবৃত্তি করছেন:

‘পুণ্য-পথের পন্থীরা গড়ে এ মসজিদ

কুরআন পড়ে দাঁড়িয়ে, বসে যায় না নিদ।

শক্ত আঘাতে পাথর ছুটছে দিগ্বিদিক।’

এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কবি ও কবিতার প্রতি রসূলে করীমের সীমাহীন ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। কবি ও কবিতাকে এবং সাহিত্য ও সাহিত্যিককে ভালোবাসা তাই সুন্নাতে রসূলের অন্তর্ভুক্ত। কবি ও কবিতার প্রতি অবজ্ঞা বা অনাগ্রহ সুন্নাতে রসূলের পরিপন্থী। এ বিষয়টি সবাইকে জানানো এবং সবার মধ্যে কবি ও কবিতার প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা সৃষ্টি করা রসূলের একটি সুন্নাতকে সমাজে চালু করারই নামান্তর। লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত সম্প্রদায়, বিশেষ করে আলেম সমাজের উচিত এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখা।

রসূলে করীম স. নিজে সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন এবং কবিতা শুনতে ভালোবাসতেন এতটুকুতেই তাঁর কাব্যপ্রেম সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্যদেরও তিনি কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে কোন কোন কবিতায় রয়েছে প্রকৃত জ্ঞানের কথা।’ সাহাবীদেরকে তিনি কবিতা চর্চার তাগিদ দিতেন।

কাব্য চর্চায় সাহাবীদের ভূমিকা

রসূল স.-এর উৎসাহে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের মধ্যে যাঁদের কাব্য চর্চার যোগ্যতা ছিল তাঁরা প্রায় সকলেই কাব্য চর্চা করতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কবি হাসসান বিন সাবিত রা., লবীদ বিন রাবিয়াহ রা., কা’ব ইবনে যোহায়র রা., আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা., কা’ব বিন মালিক রা., আব্বাস বিন মিরদাস রা., যুহায়র বিন জুনাব রা., সুহায়ম রা., আন নাবিগা ওরফে আবুল লায়লা রা. প্রমুখ। মহিলা কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নবী নন্দিনী ফাতেমাতুয যোহরা রা., হযরত খানসা রা., কবি নাবিখাজাদী রা. প্রমুখ। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীনের চারজন খলিফার প্রত্যেকেই কাব্য চর্চা করতেন। এঁদের মধ্যে তিনজনই তৎকালীন আরবের প্রসিদ্ধ কবি হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন। এরা হলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক রা.. হযরত উমর ফারুক রা. ও হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.। এঁরা সবাইছিলেন স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কতটা প্রজ্ঞাবান তা নিরূপিত হতো তারা কবিতার কেমন সমঝদার সেই বিবেচনার ওপর। কবিতা ও কবিদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিরূপিত হতো আভিজাত্যের মাপকাঠি। কবিতা

রচনার যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে পরিমাপ করা হতো পাণ্ডিত্য ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। সমাজে গুণীর কদর ছিল এবং কবিরা ছিলেন সমাজের সম্মানিত আসনে।

একটা সমাজে একই সময়ে খুব বেশি লোককে আল্লাহ কবি-সাহিত্যিক ও শিল্প চর্চার যোগ্যতা দিয়ে পাঠান না। উপরে বর্ণিত সাহাবী কবিদের তালিকা প্রমাণ করে সে সময় যে কবিদের আল্লাহ সেই যোগ্যতা দিয়েছিলেন তারা সবাই কাব্য চর্চায় ছিলেন একনিষ্ঠ ও নিবেদিত। কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে তারা ছিলেন সচেতন। রসূলের উৎসাহ তাদেরকে এ কাজে আরো অনুপ্রাণিত করে। আজকে যারা মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই দৃষ্টান্ত তাদের জন্য হতে পারে আলোকবর্তিকা চমৎকারভাবে।

অশ্লীলতা বর্জনের নির্দেশ

আল্লাহর পছন্দনীয় কবিরা কেমন কবিতা বা সাহিত্য রচনা করবেন এবার সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। আল্লাহর রসূলের আগমনই হয়েছিল মানুষের মধ্যে যে কুপ্রবৃত্তি আছে তা দূর করে সেখানে সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সভ্যতার বাগানে সুবাতাস বইয়ে দেয়ার জন্য তিনি বিশ্ব-ইতিহাসে যে বিপ্লব সাধন করেন তার মূল ছিল মানব জাতির চারিত্রিক সংশোধন। সমাজ সভ্য কি অসভ্য তা নির্ধারিত হয় সে সমাজের মানুষের চরিত্রের গুণে বা দোষে। তাই সুসমাজ সৃষ্টির স্বার্থে কবিদেরকে তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তাদের বলেছেন অশ্লীলতা বর্জনের জন্য। কবিতার শ্রীল-অশ্লীলতার বিষয়ে রসূল স. এর নির্দেশনা উঠে এসেছে হাদীসে। এ প্রসংগে মুসলিম শরীফে ইমাম মুসলিম সাহাবী আবু সাঈদ খুদরীর রা. একটি রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মদীনা থেকে ৭৮ মাইল দূরে অবস্থিত আরজ নামক এক পল্লীর মধ্য দিয়ে আমরা রসূলুল্লাহর স. সাথে যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের সামনে এসে পড়লো এক কবি। সে তার কবিতা পাঠ করে চলছিল। রসূলুল্লাহ স. বললেন, ‘এই শয়তানটাকে ধরো, তোমাদের কারোর পেট (এমন) কবিতায় ভরে থাকার চাইতে পুঁজে ভরে থাকা ভালো।’ উল্লেখ্য, এ কবির কবিতা ছিল অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ।

অনেকে মনে করেন সাহিত্যে অশ্লীলতার আমদানি সাম্প্রতিক বা আধুনিক সময়ের বিষয়। আধুনিকতা মানেই অশ্লীলতা। কিন্তু বিষয়টি মোটেই তা নয়। এ ক্ষেত্রে জাহেলী যুগের প্রখ্যাত কবি ইমরাউল কায়েসের কবিতা সম্পর্কে রসূলের স. মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ইমরাউল কায়েস ছিলেন অশ্লীলতার দীক্ষাগুরু। কিন্তু ‘বর্ণনার পারিপাট্য, উপমা গ্রহণের রীতি এবং প্রকাশভঙ্গির দক্ষতা’ তাঁর কবিতাকে করেছিল মোহময় ও আকর্ষণীয়। রসূলে করীম স. তার কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘নিশ্চয় তার ভাষায় আছে সম্মোহনী শক্তি এবং কাব্য-কর্মে আছে বর্ণনার পরিপাট্য’। এরপর তার কবিতার অশ্লীলতার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘দুনিয়ায় তিনি খ্যাতনামা হলেও আখিরাতে তার নাম নেবার কেউ থাকবে না। কবিদের যে বাহিনী জাহান্নামের দিকে যাবে সে থাকবে তার পতাকাবাহী।’

অশ্লীলতা বর্জনের ব্যাপারে সাহাবী কবিদের প্রতি আল্লাহর নবীর কঠোর নির্দেশ ছিল। তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম গ্রহণের পরেও যে অশ্লীল কবিতা ছাড়তে পারলো না, সে যেনো তার জিভটাই নষ্ট করে ফেললো।’ অন্য এক হাদীসে বলেছেন, ‘কারো পেট বা হৃদয়ে যদি পুঁজ জমে পচে যায়, তবে সেই পেট বা হৃদয় অশ্লীল বা মন্দ কবিতার চেয়ে উত্তম।’ আরেক হাদীসে বলেছেন, ‘অশ্লীল কবিতা দিয়ে তোমাদের দেহ মন ভর্তি করার চেয়ে রক্ত পুঁজ দিয়ে পরিপূর্ণ করা অনেক ভালো।’

এসব হাদীস এ কথা অকাট্যভাবেই প্রমাণ করে, সাহিত্যে অশ্লীলতা প্রকাশের কোন সুযোগ ইসলাম রাখেনি। সাহিত্য বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যারা কাজ করবেন তাদের জন্য ইসলাম কোন আলাদা বিধান দেয়নি। প্রচলিত বিধানের আলোকেই তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লামা ইকবাল ও কবি ফররুখ আহমদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। তারা ইসলামী বিধানের আওতায়ই সাহিত্য চর্চা করে বড় কবি হবার সর্বজন স্বীকৃত মর্যাদা লাভ করেছেন।

মহানবীর কাব্য বিচার

শিল্প-সাহিত্যের সমালোচনা তারাই করতে পারেন যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পণ্ডিত, তার অন্তর্নিহিত মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন এবং শিল্প-সাহিত্যের দোষ-গুণ বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. যে একজন শ্রেষ্ঠ কাব্যসমালোচক ছিলেন হাদীস শাস্ত্র থেকে সে কথাও স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। বিভিন্ন সময়ে কবি ও কবিতা সম্পর্কে তিনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, শ্রেষ্ঠ কাব্য সমালোচকদের চাইতেও যা হৃদয়গ্রাহী ও চিত্তাকর্ষক। তার কয়েকটি নমুনা এখানে তুলে ধরছি।

তিনি বলেছেন, ‘আরবদের সুসংবদ্ধ কথা হলো তাদের কবিতা। কবিতার ভাষায় (তাদের কাছে) কিছু চাইলে তারা তা মন ভরে দান করে। তাদের রোষের আগুন নির্বাপণ করে কবিতার অন্তঃসলিলা প্রবাহ। সাহিত্য-বাসরে কবিতাই হলো তাদের জন্য মনোহর উপঢৌকন।’ অন্য এক হাদীসে রসূল স. বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কবিতা হচ্ছে সুসংবদ্ধ কথামালা। কাজেই যে কবিতা সত্য-আশ্রিত সে কবিতা সুন্দর। আর যে কবিতা সত্য বিবর্জিত সে কবিতার মধ্যে কোন মঙ্গল নিহিত নেই।’

অন্য এক হাদীসে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা কথার অনুরূপ। ভালো কথা যেমন সুন্দর তেমনি ভালো কবিতাও সুন্দর। খারাপ কবিতা খারাপ কথার মতোই অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয়।’ কবিতার সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কবিতা ও সাধারণ কথাবার্তার বিচার একই নিক্তিতে হতে হবে। অনাবিল এবং পরিমল কথাবার্তার যে মূল্য, শ্লীল কবিতারও সেই মূল্য। অশ্লীল বক্তব্য যেমন অপ্রীতিকর, অশ্লীল কবিতাও তেমন।’

কবিতা সম্পর্কে এমন উচ্চাঙ্গের মূল্যায়ন তিনিই করতে পারেন যিনি কবিতার বোদ্ধা পাঠক। একটি সমাজ বিপ্লবের জন্য রাজনীতি হচ্ছে ডাল-ভাতের মতো যা সব সময়ই খেতে হয় এবং তা আমাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটায়, অর্থনীতি হচ্ছে মাছ-গোশতের মতো যা আমাদের শরীরের ক্ষয় রোধ করে এবং পরিপুষ্টি জোগায় আর সাহিত্য হচ্ছে শাকসব্জি ও তরকারীর মতো যা আমাদের ভিটামিনের যোগান দেয় ও প্রাণবন্ত রাখে। এই প্রাণবন্ততা একটি জাতির স্বাধীন অস্তিত্বের রক্ষক এবং নেতৃত্বের নিয়ামক। আপন অস্তিত্বের স্বার্থেই মহানবী স. সাহিত্যের ব্যাপারে সময় দিয়েছেন এবং তাঁর কাব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্যের গতিধারাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।

সমসাময়িক কবিদের কাব্য বিশ্লেষণ

রসূলে করীম স. শুধু কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ সমালোচকই ছিলেন না, তিনি নিয়মিত সমসাময়িক কবিদের রচনার খোঁজখবর রাখতেন। তাদের রচনা সম্পর্কে আলোকপাত ও মন্তব্য করতেন। এখানেও তাঁর কাব্যপ্রীতির অনন্য নিদর্শন পাওয়া যায়। মহানবী স. কর্তৃক সমসাময়িক কবিদের কাব্য বিশ্লেষণের কিছু নমুনা উদ্ধৃত করছি। উমাইয়া ইবনে আবী সান্তের কবিতা শুনে রসূল স. মন্তব্য করেছিলেন, ‘উমাইয়া তো প্রায় মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।’ অন্য এক জায়গায় এ কবি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উমাইয়ার কবিতা ঈমান এনেছে, অথচ তার মন এখনও কুফরির তমসায়।’

অনুরূপভাবে কবি লবীদ ইবনে রাবিআহ্’র (মৃত্যু ৬৬১ খ্রি.) একটি কবিতা রসূল স. খুব বেশি পছন্দ করতেন। এ কবিতার একটি পঙক্তি ছিল: ‘জেনে রাখো, আল্লাহ্ ছাড়া আর সব কিছুই বাতিল।’ এ সম্পর্কে রসূল স. এর মন্তব্য: ‘কবিতায় যে সব সত্য কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে সত্য কথাটি হচ্ছে লবীদের এই কবিতাটি।’

আন্ তারা  বিন শাদ্দাদ জাহেলী যুগের একজন প্রখ্যাত কবি ছিলেন। রসূল স.-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির বিশ বছর আগে তার মৃত্যু হয়। তার কবিতা আরববাসীর মুখে মুখে প্রচারিত ছিল এবং রসূলে করীম স. নিজেও তার কবিতায় মুগ্ধ ছিলেন। কবি আন্ তারা সম্পর্কে রসূলে করীম স.-এর মন্তব্য: ‘আন্ তারা ছাড়া অন্য কোন আরববাসীর এত প্রশংসা আমার কানে পৌঁছেনি। (জীবিত থাকলে) তাকে দেখার আমার বড় ইচ্ছা ছিল।’ রাহমাতুললিল আলামীন, সাইয়েদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে কবিতার জন্য একজন কবিকে দেখার এই যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এর দ্বারা কবি ও কবিতার প্রতি তাঁর প্রেমেরই অনন্য প্রকাশ ঘটেছে।

কবি সুহায়ম-এর একটি কবিতা একবার মহানবী স.-এর সামনে আবৃত্তি করা হলো। তার একটি চরণ ছিল এরকম:

‘স্তবকীর্তন তার করি অনিমেষ

দয়ার দরিয়া যেন হয় না তা শেষ।’

শুনে মহানবী স. বললেন, ‘বেশ তো। ঠিক কথাই বলেছে কবি। এ ধরনের কথায় আল্লাহতা’লা খুশি হন। আর যাকে আল্লাহ্ সোজা পথে রেখেছেন এবং নৈকট্য দিয়েছেন সে জান্নাত পাবে।’

মহানবী স. যে সমসাময়িক কবিদের কাব্য চর্চা সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতেন এবং সে আলোকে ঈমানদার কবিদেরকে পথনির্দেশনা দিতেন সেরকম বহু ঘটনা হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে। রসূলের এ মন্তব্যগুলো থেকে সাহিত্যের ব্যাপক দিকনির্দেশনা বেরিয়ে আসে। এ দিকনির্দেশনাই একজন লেখককে তার পথ প্রদর্শন করবে।

ঈমানদার কবিদের কাব্য কর্মের খোঁজখবর নেয়া ও বক্তৃতায় কবিতার ব্যবহার

সমসাময়িক ঈমানদার কবিদের কবিতা নিয়ে রসূল স.-এর ঔৎসুক্য ছিল অতুলনীয়। একবার মহানবী স. হয়রত হাসান বিন সাবিত রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আবু বকরকে নিয়ে কোন কবিতা কি এ পর্যন্ত লিখেছো?’ হযরত হাসান রা. জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ লিখেছি।’ রসূল স. বললেন, ‘শোনাও তো দেখি।’ কবি হাসান বিন সাবিত রা. হযরত আবুবকর রা.-কে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা শোনাতে শোনাতে যখন নীচের পঙক্তিগুলো পড়তে লাগলেন:

          ‘সুউচ্চ সওর গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি সে তিনিই

         (যখন) রক্ত লোলুপ শৃগালেরা ওঁকে শুঁকে শিখরে এলো

          রাসূলের সঙ্গে আছেন সদা এক ছায়াতরু

  সবাই জানেন নবীর পরে তিনি সৃষ্টি মাঝে সবার চেয়েসেরা।’

  তা শুনে মহানবী স. হেসে বললেন, ‘ঠিক বলেছো হাসান। যা বলেছো তার যোগ্য তিনিই।’ এভাবেই তিনি বিভিন্ন সাহাবী কবিকে ডেকে দিকনির্দেশনা দিতেন। মানুষের সুকীর্তি তুলে ধরার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন।

হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, রসূল স. সাহাবী কবিদের সুন্দর সুন্দর কবিতাগুলো মুখস্থ করে রাখতেন এবং বক্তৃতা দেবার সময় বক্তৃতাকে হৃদয়গ্রাহী করার জন্য সেইসব কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তৃতা করতেন। তিরমিযী শরীফের বর্ণনা: হযরত আশেয়া সিদ্দীকা রা.-কে প্রশ্ন করা হলো, ‘মহানবী স. কি তাঁর বক্তৃতায় কখনো কবিতার উদাহরণ নিয়ে আসতেন?’ হযরত আয়েশা রা. উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, উদাহরণ দিতেন বৈকি। তিনি কবি ইবনু রাওয়াহার কবিতা দিয়ে উদাহরণ টানতেন। কখনো বা উপমা দিতেন তারাফ বিন আবদ-এর এ কবিতা দিয়ে:

       ‘অনাগত কাল শিখাবে তোমায় যা তুমি জানতে না,

        এবং নিয়ে আসবে খবর, কভু যা শোননি।’

সাবা মুয়াল্লাকার কবি লবীদ ইবনে রাবিআহ্’র কবিতার দু’টি চরণও এভাবে হাদীস শাস্ত্রের অংশ হিসাবে অমর হয়ে আছে:

       ‘আলা কুলু শাইয়্যিন মা খালাল্লাহু বাতেলু,

       অকুলু নায়িমিন লা মহালাত যাইলু।’

অর্থাৎ

       ‘সাবধান হও, আল্লাহ্ ছাড়া আর সবই মিথ্যা, অসার

       সব নিয়ামতইএকদিন হবে অবলুপ্ত,

       শুধু অবলুপ্ত হবে না জান্নাতের অমূল্য সম্ভার।’

রসূলে করীমের এ আচরণ আমাদের জন্য এক অনুপম শিক্ষা। বক্তৃতায় কবিতার ব্যবহার বক্তব্যকে করে প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। মানুষের সামনে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার সময় আমাদের আলেম সমাজ এখনো ফারসী কবিতা আবৃত্তি করেন। সেই কবিতার সুরটিই জনগণ মুগ্ধ হয়ে শোনে। মাতৃভাষা থেকে অমূল্য কবিতা তুলে ধরতে পারলে তা হবে আরো আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক। যাদেরকে প্রতিনিয়তই জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয় তারা রসূলের এ সুন্নাতটি আমল করতে পারেন।

কবিদের খেতাব প্রদান ও তাঁদের জন্য দোয়া করা

হাদীস শরীফের বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, কবিদের পুরস্কৃত করা, খেতাব প্রদান এবং সভাকবি করার রেওয়াজ মহানবী স.-এর এক অনন্য অবদান। রসূলে মকবুল স. তাঁর প্রিয় সাহাবী কবিদের মধ্য থেকে কবি হাসসান বিন সাবিত রা.-কে তাঁর সভাকবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হতো, ‘শায়েরুর রসূল’ বা ‘রসূলের কবি’।

ঈমানদার কবিরা যেন উত্তম কবিতা রচনা করতে পারেন সেজন্য মহানবী স. কবিদের নাম ধরে ধরে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। তিনি এ দোয়া করতেন উচ্চস্বরে, যেন অন্যান্য সাহাবীও শুনতে পান। অধিকাংশ সময় তিনি এ দোয়া করতেন কবিদের সম্মুখে, যেন কবিরা অধিক আস্থাশীল, দায়িত্ববান এবং সৃজনশীলতায় আরো যত্নবান হওয়ার প্রেরণা পায়। কবি হাসান বিন সাবিত কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে রসূলে খোদা স. তাঁর জন্যে এ বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, রুহুল কুদুসকে দিয়ে তুমি তাকে সাহায্য করো।’

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস থেকে জানা যায়, শায়েরুর রসূল কবি হাসসান বিন সাবিত কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে কবিকে উৎসাহিত করার জন্য কখনো কখনো মহানবী স. সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, ‘হাসানের জিভ যতদিন রসূলের পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে, ততদিন তার সাথে জিব্রীল থাকবেন।’ রসূলের এ সুন্নাতটি আজ মুসলিম সমাজে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নেই। কবিদের নৈকট্য দান এবং তাদের জন্য দোয়া করার সুন্নাতটি যদি সমাজে চালু করা যায় তবে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিশেষ করে বড় বড় মাহফিলে ইসলামী চেতনাসম্পন্ন কবিদের জন্য নাম ধরে দোয়া করলে আল্লাহ নিশ্চয়ই বাতিল কবিদের চাইতে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়িয়ে দেবেন। আল্লাহর রসূল যেহেতু কবিদের উপস্থিতিতে তাদের নাম ধরে দোয়া করেছেন এই প্রমাণ হাদীস শরীফে পাওয়া যায় সে জন্য এটা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার কোন অবকাশ নেই। আমাদের আলেম সমাজ এবং ইসলামী নেতৃবৃন্দ এই সুন্নতটি চালু করলে দোয়া পাবার আশায় সাধারণ কবিরাও ইসলামী পরিবেশে আসার জন্য অনুপ্রাণিত হবে এবং দেখা যাবে অচিরেই বাতিল সাহিত্যিকের চেয়ে ইসলামী কবি-সাহিত্যিকের পাল্লা ভারী হয়ে গেছে।

কবিদের পুরস্কৃত করা এবং প্রাপ্যের চেয়ে অধিক সুবিধা প্রদান

একবার মিশরের রোমক সম্রাট দুই অপরূপা সুন্দরী রমণীকে রসূল স.-এর খেদমতে পাঠালেন উপঢৌকন হিসাবে। মহানবী স. এদের মধ্য থেকে শিরী নামের এক রমণীকে ‘রসূল স.-এর কবি’ হিসাবে খ্যাত কবি হাসান বিন সাবিতকে উপহার হিসাবে প্রদান করলে হাসান বিন সাবিত রা. তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এভাবে মহানবী স. কবি হাসসান বিন সাবিত রা.-কে তুষ্ট করতে চেয়েছেন। একজন কবির প্রতি মহানবীর ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের এ ছিল এক অনন্য প্রকাশ। কবিদেরকে তুষ্ট করার চেষ্টা রসূলের এক অনন্য সুন্নত। এ সুন্নতের হক আদায় করতে হবে নিজের প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ বস্তু কবিদের উপঢৌকন দিয়ে, যেমনটি দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় নবী।

কবি কা’ব ইবনে যুহায়র ছিলেন প্রসিদ্ধ ‘সাবা মুয়াল্লাকা’র (ঝুলন্ত কবিতা সপ্তক) অন্যতম কবি যুহায়র-এর সুযোগ্য সন্তান। কা’ব রা. পিতার প্রতিভার উত্তরাধিকারী ছিলেন। কিন্তু ইসলামের শত্রুতার ব্যাপারে তাঁর প্রতিভা, তেজস্বিতা ও উত্তরাধিকার ছিল এমনি এক মারাত্মক পর্যায়ের যে, মক্কা বিজয়ের পর যে দশজন কুখ্যাত কাফিরের প্রাণদণ্ড ঘোষিত হয়েছিল, যুহায়রের পুত্র কা’ব ছিলেন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। তখনও তিনি ইরাকে অবস্থান করে আল্লাহর নবী স. ও ইসলামের বিপক্ষে কুৎসা ও বিদ্বেষ প্রচারে লিপ্ত ছিলেন। কিছুদিন পর আল্লাহপাক তাঁর মনোবিপ্লব সাধন করায় তিনি ছদ্মবেশে মদিনায় উপস্থিত হয়ে রসূল স.-এর কাছে নিজেকে নিবেদন করেন। এসময় কবি কা’ব ইবনে যুহায়র তার বিখ্যাত কবিতা ‘বা’নাত সুআদ’ রসূলুল্লাহ স.-এর দরবারে পেশ করলে মহানবী স. খুশি হয়ে নিজের গায়ের চাদর খুলে কবিকে তা উপহার হিসাবে প্রদান করেন। ইসলামের চরম শত্রুও এভাবে যেন ইসলামে দাখিল হওয়ার পরিবেশ পায় সেই পথ আমাদের উন্মুক্ত রাখতে হবে। রসূল স. কতটা আবেগ আপ্লুত হলে নিজের গায়ের চাদর খুলে একজন কবিকে উপহার দিতে পারেন তা কি কেউ কল্পনা করতে পারেন? কবিদের প্রতি এই ভালোবাসা প্রদর্শনের সময় এসেছে আজ। ইসলামকে বিজয়ী করতে হলে সভ্যতার নির্মাতা এবং মানুষের হৃদয়ের স্বপ্নপুরুষ কবিদের ভালোবেসেই জনগণের হৃদয়কে জয় করতে হবে। যারা এ ভালোবাসা দিতে ব্যর্থ হবে তাদের পক্ষে আর যা কিছুই হোক সমাজে বিপ্লব সাধন করা সম্ভব হবে না।

‘কাসিদাতুল বুরদাহ’-এর রচয়িতা সাইদ বিন হাসান বুসীরী (জন্ম ১২১২ খৃঃ), মিসরের বুসীর নিবাসী বার্বার জাতীয় একজন কবি, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে নিরাময়ের আশায় তিনি ‘কাসিদাতুল বুরদাহ’ কবিতা রচনা শুরু করলেন। ‘বানাত সুআদ’-এর মত কিছু কালজয়ী পঙক্তি রচনা করবেন এবং রসূলে পাক স.-এর রওজায় তা পাঠ করবেন এরূপ ছিল কবির ইচ্ছা। প্রগাঢ় প্রেমোন্মাদনায় কাসিদা রচনা সমাপ্ত হলে স্বপ্নে তিনি রসূলুল্লাহ স.-এর দর্শনলাভ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, স্বপ্নাবস্থায় রসূল স. কবিকে আপন চাদর পরিয়ে দিয়েছিলেন [যেভাবে হযরত কাব রা. চাদর উপহার পেয়েছিলেন। এবং সকালে জেগে উঠে কবি নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেখতে পান।’

হুনায়নের যুদ্ধের পর মহানবী স. প্রাপ্ত গণীমত মুজাহিদদের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছিলেন। কবি আব্বাস বিন মিরদাসকে দিলেন চারটি বলিষ্ঠ উট। এতে তাঁর মন ভরলো না। কবিতার মাধ্যমে অনুযোগের স্বরে তিনি বললেন:

        ‘কোন দিনই বধ্যভূমি ও কেল্লাগুলো

         ঘাড় ভাঙতে পারেনি এই মিরদাসের

         কখনো যে ছিলাম পিছে তেমনও নয়

         আজকে যদি হইগো নীচু উঠাবে ফের

         মিরদাসেরে সে লোক এখন কই?’

কবিতা শুনে মহানবী স. বললেন, ‘ওরে, কেউ কি কবির মুখ বন্ধ করতে পার?’ একথা শুনে হযরত আবুবকর রা. তাকে নিয়ে গেলেন। বেছে বেছে একশ উট নিয়ে যেতে দিলেন তাকে। কবি খুশিতে ডগমগ হয়ে গেলেন এ বদান্যতায়। যে নবী এ বদান্যতা দেখিয়েছিলেন সেই নবীরই উম্মত আমরা। অথচ কবিদের আজ পেটে ভাত জোটে না, চিকিৎসা করানোর টাকা জোটে না, তাদের রচিত বই পাণ্ডুলিপির পর পাণ্ডুলিপি হয়ে পড়ে থাকে, প্রকাশ করার সাধ্য হয় না। কবিদের বলা হয় সমাজদেহের চক্ষু। সেই চক্ষুগুলো সজাগ না হলে যে সমাজ বিপ্লব হয় না সে কথা বুঝেছিলেন আল্লাহর নবী। আমরা যারা রসূলের উম্মত আমাদের মনে রাখতে হবে কবিদের প্রতি এই উদারতা প্রদর্শন ও ভালোবাসা পোষণ রসূলেরই সুন্নত। এ সুন্নত চালু করতে না পারলে আজকের কবিদের চোখগুলোও আমরা খুলতে পারবো না। একটি সুন্দর সমাজ নির্মাণ যাদের স্বপ্ন, সুন্দর সমাজের স্বপ্নবোনার কারিগর কবিদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব তাদেরই পালন করতে হবে।

কবিদেরকে অর্থ সাহায্য করা এবং সম্মান ও মর্যাদা প্রদান

ভাবের রাজ্যে বিচরণের কারণে স্বাভাবিকভাবেই লেখক ও কবিরা বিষয়বুদ্ধিতে থাকে অপটু। আবার আত্মসম্মানবোধ টনটনে থাকার কারণে কারো কাছে কিছু চাইতেও পারে না। ফলে দেখা যায়, সভ্যতার বাগান বানায় যে কবিরা, মানুষের মনে সুখের প্লাবন আনে যে কবিরা, তাদের ভাগ্যে জোটে দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণাকাতর জীবন। এ দুর্দশা লাঘবে মহানবী স. যেভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন, কবিদের সম্মানে যে চূড়ান্ত কথা বলেছেন, তারচে চূড়ান্ত কোন কথা পৃথিবীতে কেউ কোনদিন বলতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেছেন, ‘কবিদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার সমতুল্য।’ (মুহাদারাত আল উদাবা)

সন্তানের কাছে পিতা-মাতার যে মূল্য, সভ্যতার কাছে কবির মূল্য তেমনি। পিতা-মাতার কাছে ঋণী সন্তান, কবির কাছে ঋণী জাতি। এ বাণীর মাধ্যমে মহানবী স. চেয়েছেন জাতি যেন সে ঋণ পরিশোধ করে। অথচ মাদ্রাসা মসজিদ নির্মাণের সমান গুরুত্বও আমরা একে দেই না। আজকে মুসলিম বিশ্ব সবচে বড় যে সংকটে ভুগছে তা হলো সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরাই এ থেকে জাতিকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হাত খুলে কবিদের সহায়তা করা, যার অভাব এখনো সমাজে সুতীব্রভাবেই অনুভূত হয়। রসূল স. কবিদের শুধু অর্থ সাহায্য করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁদের যথেষ্ট সম্মান এবং মর্যাদাও দিতেন। তিনি কবিদের যে অতুলনীয় সম্মান ও মার্যাদা দিয়েছেন তা ছিল উপমারহিত। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মসজিদে নববীর ভেতরে শুধুমাত্র কবিতা পাঠ করার জন্য মহানবী স. একটি আলাদা মিম্বার (মঞ্চ) তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে কবি হাসান বিন সাবিত রা. সাহাবীদের কবিতা পাঠ করে শোনাতেন।

কবিতা লিখে জান্নাতের সুসংবাদ লাভ

মহানবী স. অনেককেই জীবিতাবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। কবিতা লেখার পুরস্কার হিসাবে যখন জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে যান কোন কবি তখন তাঁর সৌভাগ্য হয়ে যায় অন্যদের ঈর্ষার কারণ। সহীহ হাদীসের বর্ণনা, কাব্য চর্চার জন্য হাসসান বিন সাবিতকে রসূল স. দুনিয়াতেই বেহেশতের সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন। রসূল স. ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘হে হাসসান, আল্লাহর কাছ থেকে তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে জান্নাত।’ এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, হাদীস আছে; যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে শিল্প সাহিত্যের প্রতি রসূলে করীমের সীমাহীন ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। কবি ও কবিতাকে, সাহিত্য ও সাহিত্যিককে ভালোবাসা তথা সংস্কৃতি চর্চা করা তাই সুন্নাতে রসূলের অন্তর্ভুক্ত। শিল্পের প্রতি, কবি ও কবিতার প্রতি অবজ্ঞা বা অনাগ্রহ প্রকাশ সুন্নাতে রসূলের পরিপন্থী।

আজকে যারা ইসলামী সাহিত্যের চর্চা করছেন তাদের এ কথা গভীরভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, সাহিত্য চর্চা কোন তুচ্ছ কাজ নয়, বরং সভ্যতা বিনির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আল্লাহ তাদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। এ কাজের জন্য যে মেধা ও যোগ্যতা দরকার আল্লাহই তা তাদেরকে দিয়েছেন। আল্লাহর দেয়া এ বিশেষ নেয়ামতের সদ্ব্যবহার না হলে তার জন্য তাকে পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। যেখানে আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরার নামকরণ আশ্ শোয়ারা ‘কবিরা’ রেখে কবিদেরকে চূড়ান্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন সেখানে কাব্য চর্চা তথা সাহিত্য সাধনাকে গৌণ ভাবার কোন অবকাশ নেই। অপরদিকে রসূলে করীম স. সাহিত্য চর্চার প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা আমাদেরকে বুঝতে হবে। মহানবী স. ই আমাদের জীবনাদর্শ। তিনি যা করেছেন করতে বলেছেন বা করার জন্য সম্মতি দিযেছেন তা-ই সুন্নাহ। সাহিত্যের ব্যাপারেও একই কথা। তিনি এ ব্যাপারে যা করছেন বা করতে বলেছেন তার যথাযথ অনুসরণ করার মধ্যেই আমাদের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত। আজ যেটি সবচে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে খণ্ডিত ইসলাম নয়, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ। আর এ অনুসরণ কেবল কথার মধ্যে না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করা দরকার।

আজ মহানবী বেঁচে নেই। আছে তাঁর উম্মাহ, আছে বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং তাদের নেতৃবৃন্দ। মহানবীর এসব সুন্নতকে সমাজে প্রচলন করা এবং জারি রাখার দায়িত্ব আজ এই উম্মাহর। মহানবীর যাঁরা সত্যিকার অনুসারী এবং যাঁরা পৃথিবীতে কুরআনের শাসন কায়েমের সংগ্রামে রত, জ্ঞান চর্চার এ কুরআনিক গুরুতুটি তাদের উপলব্ধি করতে হবে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে। সাহিত্য সংস্কৃতির ব্যাপারে ইসলামী দর্শন কি তা উম্মতে মুহাম্মদীর কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরার গুরু দায়িত্বও তাদেরই নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আমরা এটা করতে সক্ষম হবো ততই ইসলামকে বিজয়ের আসনে নিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *