আধুনিক শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিকাংশই আজ এক ধর্মীয় সমস্যার সম্মুখীন। ধর্ম কি প্রকৃতপক্ষে জীবনের কোনো বাস্তব সত্য? অতীতে হয়ত তা সত্য ছিল, কিন্তু আজকের বিশ্বে বিজ্ঞান যখন সমগ্র জীবনধারাকে পাল্টে দিয়েছে এবং জীবনে আজ যখন বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের অনুমোদনের বাইরে কোন কিছুর স্থান নেই, তখনও কি সেই মর্যাদা দাবী করতে পারে? ধর্ম কি মানবতার কোন প্রকৃত প্রয়োজনের প্রতিনিধিত্ব করে? না এটা ব্যক্তির মজ্জাগত গঠনের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল? কারণ, এর বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে আদৌ যদি কোন পার্থক্যই থাকে তবে মানুষ একে বিশ্বাস না করেও চলতে পারে।
ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েও তারা এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার সম্মুখীন হন। ইসলামের সমর্থকগণ বলেন, ইসলাম শুধু একটা ধর্ম মাত্র নয়, আধ্যাত্মিক উন্নয়ন বা মানবীয় গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধনের নামও ইসলাম নয়, বরং এ এমন একটা সুসমঞ্জস ব্যবস্থা, যার মধ্যে রয়েছে একটি ইনসাফসম্মত অর্থনৈতিক বিধান, একটি সুসংহত সমাজ সংগঠন, দেওয়ানী, ফৌজদারী ও আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালা, দৈহিক বিধান সহ জীবনের প্রতি একটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর প্রত্যেকটি উৎসারিত হয়েছে ইসলামের মূল মর্মবাণী এবং উহার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা থেকে। এই সব ‘শিক্ষিত’ লোকেরা যখন ওসব কথা শোনেন তখন বেশ ফ্যাসাদে পড়েন। কেননা তারা ধারণা করে নিয়েছেন যে, ইসলাম বহু পূর্বেই মরে গেছে, কারণ ইহা সেকেলে হয়ে গেছে এবং এর প্রয়োজনীয়তাও নিঃশেষিত হয়ে গেছে। এজন্যেই প্রত্যয়শীল মুসলমানদের এরা যখন বলতে শোনেন যে, ইসলাম সুদূর অতীতের কোন ব্যাপার নয়, এটা মৃত বা সেকেলেও নয়, বরং আজকের দিনেও এটা একটা জীবন্ত ও গতিশীল জীবনব্যবস্থা-কারণ এর মধ্যে জীবনের এমন সব উপাদান রয়েছে, যা সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজমসহ মানবতার পরিজ্ঞাত কোন ব্যবস্থাতেই নেই-তখন তারা তাজ্জব বোধ করেন।
এ পর্যায়ে তাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না- তারা অধৈর্য হয়ে আল্লাহ্ বাণী প্রচারকদের উদ্দেশ্যে দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠেন: তোমরা কি এসব কথা সেই ধর্ম সম্পর্কে বলতে চাও যা দাসপ্রথা, সামন্তবাদ ও ধনতন্ত্রকে সমর্থন করে- যে ব্যবস্থা নারীকে আধা-মানুষ করে সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে; যা প্রস্তরাঘাতে হত্যা, হাত কাটা ও বেত্রদণ্ডের বিধান দেয়; যা ধনিক- সহ বিভিন্ন শ্রেণীতে সমাজকে বিভক্ত করে; যা মেহনতী জনতার মর্যাদাজনক জীবনের কোন নিশ্চয়তা দান করে না এবং যা হেন করে বা তেন করে না ইত্যাদি-এরূপ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে টিকে থাকা তো দূরের কথা, বর্তমান যুগেই বা তার অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ থাকার সম্ভাবনা কোথায়? বিজয় ও সাফল্যের কথা দূরে থাক-এরকম একটি ব্যবস্থার পক্ষে আধুনিক যুগের বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতবাদের কঠোর আঘাত মুকাবিলা করবার শক্তি কোথায়?
এ আলোচনায় অধিক দূর অগ্রসর হওয়ার পূর্বে আমরা একটু থামব এবং বুঝে দেখতে চেষ্টা করব, এইসব ‘শিক্ষিত’ সন্দেহবাদী কারা? এবং সন্দেহবাদের মূল কোথায়? এই মনোভাব কি তাদের স্বাধীন চিন্তার ফল, না-বুঝে অন্যের ধার-করা বুলি তোতা পাখীর মত তারা আওড়াচ্ছে?
আসল ব্যাপার হলো, এই সব ভদ্রলোকের এই সন্দেহবাদ মোটেই তাদের স্বাধীন চিন্তার ফল নয়, আর এর জন্মও তাদের মগজে ঘটেনি। এর প্রকৃত উৎসের জন্য আমাদের আধুনিক ইতিহাসের কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখতে হবে।
মধ্যযুগে ইউরোপ ও মুসলিম প্রাচ্যের মধ্যে অসংখ্য ক্রুসেড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উভয় দলের মধ্যে বহু রক্তাক্ত সংঘর্ষ ঘটে এবং তারপর একটি সময় আসে যখন তাদের প্রকাশ্য সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাদের সংঘাত যে তখনও সমাপ্ত হয়নি, তা বোঝা। যায় লর্ড এ্যালেনবীর একটি উক্তি থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে বৃটিশ ফৌজ কর্তৃক জেরুসালেম দখলের পর। লর্ড এলেনবী নির্মম ভঙ্গীতে উক্তি করেছিলেন: “আজ ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটল।”
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, বিগত দুই শতাব্দী ধরেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রয়েছে। তৌফিকের বিশ্বাসঘাতকার সুযোগে ১৮৮২ সালে বৃটিশ শক্তি মিসরে প্রবেশ করে। আরাবীর নেতৃত্বে পরি- চালিত গণ-আন্দোলন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তারা তার সাথে মিসরে সামরিক দখল কায়েমের ষড়যন্ত্র পাকায়। এর পর থেকে একটি মাত্র লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই বৃটিশ নীতি আবর্তিত হতে থাকে, সেটি হল- মুসলিম বিশ্বে তাদের কব্জা আরও মজবুত কর। এবং প্রাচ্যের ইসলামী ভাবাদর্শের বন্যায় তাদের কায়েমী স্বার্থ যাতে ভেসে না যায় তার খবরদারী করা। এই প্রসঙ্গে ভিক্টোরীয় যুগের বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী মিঃ গ্লাডস্টোন হাউস অব কমনেন্স যে উক্তি করেছিলেন, আমরা তারও উল্লেখ করতে চাই। পবিত্র কুরআনের একখণ্ড হাতে তুলে ধরে হাউসের সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন; “যতদিন পর্যন্ত মিসরবাসী এই গ্রন্থ আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন আমরা কিছুতেই সেদেশে শান্তির সুখ দেখব না।”
স্বাভাবিক কারণেই বৃটিশের প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়াল ইসলামী আইন-কানুনকে বিকৃত করা, মুসলমানদের অন্তর থেকে এর প্রতি শ্রদ্ধানুভূতি দূর করে দেওয়া এবং ইসলামকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত করা, যাতে করে মুসলমানেরা একে হেয় চক্ষে দেখতে শুরু করে এবং পরিণামে সম্পূর্ণরূপে একে বর্জন করে। তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ দৃঢ়মূল করার উদ্দেশ্যেই তারা এই কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিল।
মিসরে তারা যে শিক্ষানীতি প্রবর্তন করে তার ফলস্বরূপ ছাত্রগণ ইসলামের প্রকৃত রূপ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে যায়। অবশ্য এটুক তাদের জানতে দেওয়া হল যে, ইসলাম নামে একটি ধর্ম আছে যা ইবাদত, নামায-রোযা, তসবিহ-তাহলিল, যিকির-আযকার, মারেফত ইত্যাদি শিক্ষা দেয়; কুরআন নামক একখানি কিতাব আছে, যা তিলাওয়াত করলে সওয়াব হাসিল করা যায়; তাছাড়া ইসলাম ব্যক্তিজীবনে নৈতিকতা ও দান-খয়রাতের তাকিদ দেয়। ইসলামকে রাষ্ট্রীয়-সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে বা শাসনতন্ত্ররূপে এদেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক নীতির ভিত্তি হিসাবে বা শিক্ষাব্যবস্থা হিসাবে বা একটি জীবনব্যবস্থা হিসাবে অথবা জীবনের নিয়ামক রূপে বুঝতে ছাত্রদেরকে কোন সুযোগই দেওয়া হল না। পরিবর্তে বিভিন্ন ইউরোপীয় ওরিয়েন্টালিস্ট ও অন্যান্য বিরুদ্ধবাদিগণ ইসলাম সম্বন্ধে যেসব বিরূপ মন্তব্য করেছেন তা তাদের শেখানো হল। এ সবের উদ্দেশ্য ছিল যাতে মুসলমানরা তাদের ধর্ম বর্জন করে এবং সাম্রাজ্যবাদী দূরভিসন্ধির সহজ শিকারে পরিণত হয়।
তাদের শেখানো হল জগতের একমাত্র নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা, ইউরোপীয় দার্শনিকদের উদ্ভাবিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই একমাত্র খাঁটি অর্থনৈতিক ব্যবস্ব। আর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ইউরোপবাসী যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে সেটাই হল সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ও নিখুঁত রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাদের শিক্ষা দেওয়া হল, ফরাসী বিপ্লবই মানবাধিকারের সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়, ইংরেজ জাতিই সর্বপ্রথম গণতন্ত্রের শিক্ষা দিয়ে এর ব্যাপক প্রসার সাধন করে; এবং রোমানরাই পৃথিবীতে সভ্যতার প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণ করে। এক কথায়, বৃটিশগণ ইউরোপকে এমন এক বিদ্রোহী ও দুর্দান্ত শক্তিমান রূপে চিত্রিত করে যার সামনে দাঁড়ানো বা যার অগ্রগতিতে বাধ সাধা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর প্রাচ্যকে তারা চিত্রিত করল দীনহীন এমন এক রূপে, যার নিজস্ব কোন মূল্যবোধ নেই এবং ইউরোপের গোলামী করা ও তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী নকল করা ছাড়া যার কোন গত্যন্তর নেই।
এই রাজনৈতিক পলিসির সুফল অবশেষে ফলতে লাগল। মিসরবাসীদের মধ্যে এমন একদল ‘শিক্ষিত’ লোক সৃষ্টি হল যারা তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাধীন সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের ভাবনা-চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল। তারা সম্পূর্ণভাবে ইউরোপের শিষ্য বনে গেল; তারা নিষ্ঠার সাথে তার পূজা শুরু করল; নিজেদের চোখে দেখা তাদের বন্ধ হয়ে গেল, স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার শক্তিও তারা হারিয়ে ফেলল; তারা শুধু তাই দেখতে লাগল যা ইউরোপীয়ানরা পছন্দ করত; চিন্তাও করতে লাগল তাদেরই মর্জি মাফিক।
এ দেশে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের রাজনৈতিক চক্রান্ত-জাল বিস্তার করে যা হাসিল করতে চেয়েছিল আজকের ‘শিক্ষিত’ বুদ্ধিজীবিগণ সেই উদ্দেশ্যেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। এই হতভাগ্য ব্যক্তিগণ ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ ব্যতীত আর কিছুই জানেন না। ইউরোপীয় ওস্তাদদের শিখিয়ে দেয়া বুলি ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে তাঁরা আর কোন কিছুরই খবর রাখেন না। এ জন্যেই ওদের সুরে সুর মিলিয়ে তারস্বরে এরা চীৎকার করে চলেছেন, ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে এবং বিজ্ঞানকে ইসলাম থেকে আলাদা করতে হবে।
নিজেদের অজ্ঞতা হেতু তাঁরা এ সত্যটি ভুলে যান যে, ইউরোপ যে ধর্মকে নির্বাসন দিয়েছে এবং ইসলামী আদর্শের প্রবক্তাগণ যার দিকে জনসাধারণকে আহ্বান জানান এ দু’টি বস্তু এক নয়, আর ইউরোপ যেদিন ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেদিন সেখানে যে বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল তা পৃথিবীর সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ ধরনের কোন পরিস্থিতির উদ্ভব মুসলিম প্রাচ্যে কখনো ঘটেনি, ভবিষ্যতেও কখনো তা ঘটবার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, ইসলামকে বর্জন করতে তাঁরা যখন দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান অথবা যখন তাঁরা ঘোষণা করেন যে, সমাজ ও জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে ইসলামের কোন বক্তব্য নেই, তখন তারা তাদের গুরুদের কাছ থেকে ধার করা বুলিই কপচিয়ে যান মাত্র।
ইউরোপ ধর্ম ও বিজ্ঞানের এক সংঘর্ষ-ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কারণ গির্জা (গ্রীস থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত) কতকগুলো গোঁড়া ও অন্ধ বিশ্বাস গায়ের জোরে আঁকড়ে ধরেছিল এবং সেগুলো বেদবাক্য বলে ধরে নিতে জিদ ধরছিল। তাই বিজ্ঞানের আবিক্রিয়ার ফলে যখন ঐ সব থিয়োরীর শ্রান্তি ও অযৌক্তিকতা ধরা পড়ে গেল, তখন জনগণের বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা ও গির্জার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন ছাড়া উপায় রইল না। গির্জার প্রতি অনাস্থা জাহির করতে নিয়ে তারা এই সব গির্জার পাদ্রীদের প্রচারিত ধর্মের বিরুদ্ধেও অনাস্থা ঘোষণা করে বসল। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে লড়াই ক্রমেই প্রবল আকার ধারণ করল। ইতিমধ্যে ইউরোপে গির্জা নিজের উপরে ঐশ্বরিক অধিকার আরোপ করে উৎপীড়নের মাধ্যমে সেই অধিকার প্রয়োগের চেষ্টা করলে জনগণের মধ্যে এইসব ধর্মনেতাদের কুপ্রভাব থেকে মুক্তির আগ্রহ স্বাভাবিক- ভাবেই তীব্রতর রূপ পরিগ্রহ করল। এমনিভাবে যেখানে জনগণের নিকট ধর্ম এমন এক ভয়াবহ দানবীয় রূপে আবির্ভূত হল, যা তাদের জীবনে এমন কি নিদ্রাতেও যেন মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে দাঁড়াল। এই তথাকথিত ধর্মের উৎপীড়ন এত বেড়ে গেল যে, ইহা জনগণকে গুটি কয়েক পাদ্রীর দাসানুদাসে পরিণত করতে প্রয়াস পায় এবং ঈশ্বরের নামে রাজ্যের বস্তাপচা ও উদ্ভট্ট সব মতবাদ প্রচার শুরু হয়ে যায়। পৃথিবী গোলাকার-এই মতবাদ প্রচারের অপরাধে বিজ্ঞানীদের অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হল। জুলুমবাজি ও বর্বরতার এমনিতর নৃশংস অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিটি সুস্ববুদ্ধি, স্বাধীনচেতা ও বিবেকবান মানুষ এই ঘৃণ্য দানবটিকে ধ্বংস অথবা অন্ততঃ শৃঙ্খলাবদ্ধ করার কাজে সহায়তা করা নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করলেন-করলেন যাতে করে ভবিষ্যতে আর কখনো এই অশুভ শক্তি মানুষের উপর জুলুমবাজি করতে সাহস না পায় এবং ধর্মের নাম কলংকিত করে এটা প্রমাণ করতে না পারে যে, ধর্ম বলতে শুধু অসত্য ও মিথ্যারই বেসাতি বোঝায়।
‘কিন্তু আমরা যারা ইসলামী প্রাচ্যে বাস করি, তাদের অবস্থা কি? আমরা কেন ধর্ম থেকে বিজ্ঞানকে পৃথক করতে যাব অথবা মনে করব যে, এ দুইয়ের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব রয়েছে? বিজ্ঞানের কি এমন একটিও তথ্য আছে যা ইসলাম ও তার মর্মবাণীর বিরুদ্ধে? ইসলামী রাষ্ট্রে কখনো কি বৈজ্ঞানিকদের প্রতি নিপীড়ন করা হয়েছে? ইসলামের সমগ্র ইতিহাস আমাদের সামনে রয়েছে। এ ইতিহাস আমাদের বলে দেবে, মুসলমানদের মধ্যে বড় বড় চিকিৎসাবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁদের মতামতের জন্য তাঁদের উপর কোন অত্যাচার করা হয়নি। এই সব খ্যাতনামা মুসলিম বিজ্ঞানী তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের কোনরূপ বিরোধ আছে বলে কখনো সনে করতেন না। শাসকবর্গের সাথে তাঁদের কখনো এমন কোন বিরোধ চলেনি যার ফলে তাদের যন্ত্রণা দেওয়া বা জীবন্ত পুড়িয়ে সারার প্রশ্ন উঠতে পারতো। তবে কেন এই সব “শিক্ষিত” লোকেরা বিজ্ঞান থেকে ধর্ম পৃথক করতে ওকালতি করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে কিছুই’ না বুঝে ও না জেনে আদাপানি খেয়ে এর নিন্দা করতে লেগে যান? তাদের এসব অৰুবা প্রলাপোক্তি সাম্রাজ্যবাদ শক্তির প্রবতিত শিক্ষার স্বাভাবিক বিষক্রিয়া বৈ নয়- অবশ্য তাঁরা এ সম্পর্কে সচেতন নয়।
ইসলাম ও সভ্যতা
“সেই হাজার বৎসর পূর্বে যখন মানুষ তাঁবুতে বাস করত, সেই যুগে কি তোমরা আমাদের ফিরে যেতে বল? মরুভূমির সেই বন্য ও অসভ্য বেদুঈনদের জন্য ইসলাম ঠিকই ছিল, কারণ এটা এমন একটা সহজ ধর্ম ছিল, যা তাদের কাছে মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয় লাগত। কিন্তু আজকের দুনিয়ার সুপারসনিক প্লেন, হাইড্রোজেন বোমা ও চলচ্চিত্রের যুগে কি আল্লাহর ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোন সভ্যতা কোন কাজে লাগবে? আজকের উন্নত সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে ইহা চলতে পারবে না। ইহা গতিহীন। সুতরাং দুনিয়ার অন্যান্য জাতির মত আমাদেরও যদি প্রকৃত প্রস্তাবে সভ্য ও উন্নত হতে হয় তবে অবশ্যই আমাদের এসব ঝেড়ে মুছে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।”
মিসরে গত দুই বৎসর যাবত’ কর্মরত জনৈক ‘শিক্ষিত’ ইংরেজের সাথে সাক্ষাতকালে উপরোক্ত ধরনের সন্দেহ-সংশয় আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। মিসরীর কৃষকদের জীবন-মান উন্নয়নের প্রচেষ্টায় সাহায্য করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের যে একদল বিশেষজ্ঞ এসেছেন, ইনি তাদেরই একজন। কিন্তু এই জনগণের জন্য তাদের সর্বপ্রকার ‘প্রেম’ থাকা সত্ত্বেও তারা এদের ভাষা শেখে নি বা শিখতে চেষ্টা করেনি। এ কারণেই মিসর সরকার তাদের ও স্থানীয় কৃষকদের মাঝে দোভাষী হিসাবে আমাকে নিযুক্ত করেন। এতে করেই আমি ‘শিক্ষিত’ ইংরেজটির সংস্পর্শে আসি।
প্রথমেই তাকে সুষ্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম যে, আমরা মিসরীয়র। তাদের ঘৃণা করি এবং যতদিন তারা প্রাচ্যে হামলা চালিয়ে যাবে আমরাও তাদের ঘৃণা করে চলব। আমি বললাম, তাদের দোসর আমেরিকা গয়রহ্কেও আমরা মিসর, ফিলিস্তিন প্রভৃতি প্রশ্নে অন্যার নীতি গ্রহণের কারণে ঘৃণা করি। আশ্চর্য হয়ে তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং পরে বললেন: “আপনি কি কমিউনিস্ট?”
…………………..
১. এ পুস্তকখানি মিসরে সর্বপ্রথন ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়।
আমি বললাম যে, আমি কমিউনিস্ট নই, মুসলমান। আমি বিশ্বাস করি যে,
ধনতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট উভয় সভ্যতার তুলনায় অনেক বেশী শ্রেষ্ঠ ইসলামের সভ্যতা। আমি আরও মনে করি যে, মানুষের পরীক্ষিত সমস্ত বিধানের মধ্যে ইসলামী ব্যবস্থাই সর্বোত্তম; কারণ মানুষের সামগ্রিক জীবনই এর আওতাভুক্ত, আর জীবনের বিভিন্ন দিকের একটি সুষ্ঠু ভারসাম্য রয়েছে এতে।
আমাদের আলোচনা এভাবে এগিয়ে চল্ল। দীর্ঘ তিন ঘন্টা কথাবার্তা
হওয়ার পর তিনি বললেনঃ “হতে পারে, আপনি ইসলাম সম্বন্ধে যা বলছেন তা সত্য, কিন্তু আমি তো নিজেকে আধুনিক সভ্যতার অবদান থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। প্লেনে ভ্রমণ করা আমি পছন্দ করি, রেডিওতে মনমাতানো সঙ্গীত শুনতে আমার ভাল লাগে। এসব আনন্দ থেকে নিজেকে আমি বঞ্চিত করতে চাই না।”
তাঁর উত্তরে অবাক হয়ে আমি বল্লাম: “কিন্তু কে আপনাকে এসব আনন্দ উপভোগে নিষেধ করছে?”
–-“ইসলাম গ্রহণ করা অর্থ কি বর্বর যুগে এবং তাঁবুর জীবনে ফিরে যাওয়া নয়?”
এটা সত্যিই আশ্চর্য লাগে যে, ইসলামের বিরুদ্ধে এমনি ধরনের সন্দেহ বর্ষণ অবিরাম ধারায় চলেছে, যদিও এসবের কোন যুক্তিযুক্ত ভিত্তি নেই। যাঁরাই এই ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেন এ ব্যাপারে তাঁরা একমত হবেন। সভ্যতা ও প্রগতির পথে ইসলাম মুহূর্তের তরেও প্রতিবন্ধক হয়নি।
ইসলাম এমন এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছিল, যারা অধিকাংশই ছিল বেদুঈন। তারা এত কঠোর ও নির্মম প্রকৃতির ছিল যে, কুরআন শরীফে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘বেদুঈনরা অধিকতর কপট ও ধর্মবিরোধী।”
ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীতি এই যে, ইহা এসব উগ্র ও কঠোর প্রকৃতির বেদুঈনদেরকে একটি মানবিক গুণ সম্পন্ন জাতিতে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছিল। শুধু তারাই যে সৎপথে পরিচালিত এবং পশুত্বের স্তর থেকে মানবিক স্তরে উন্নীত হয়েছিল তা নয়– আল্লাহর পথে মানবতাকে পরিচালনার নেতৃত্বও তারা লাভ করেছিল। মানুষকে সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত করা এবং আত্মার বিকাশ সাধনে ইসলানের অলৌকিক ক্ষমতার ইহা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আত্মার উন্নতি সাধন এমন একটি মহৎ কাজ, যা মানুষের চেষ্টা ও পরিশ্রমের লক্ষ্য হতে পারে; কারণ ইহা সভ্যতার অন্যতম চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু ইসলাম শুধুমাত্র আত্মিক উন্নতিতেই তুষ্ট থাকেনি। আজ যা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং যাকে অনেকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু মনে করে, সভ্যতার সেসব তাবৎ সামগ্রীকেই ইসলাম গ্রহণ করেছে। একেশ্বরবাদের খেলাপ না হওয়া পর্যন্ত এবং জনগণকে সৎ কাজ থেকে বিভ্রান্ত না করা পর্যন্ত ইসলাম বিজিত সমস্ত দেশের সভ্যতাকে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতিবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র সহ সমগ্র গ্রীক বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকারকে ইসলাম পৃষ্ঠপোষকতা দান ও সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম নতুন নতুন অবদান সংযোজন করেছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপারে ইসলাম গভীর ও একনিষ্ঠ আগ্রহ দেখিয়েছে। আন্দালুসিয়ার ইসলামী বৈজ্ঞানিক অবদানের উপরেই ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও তার আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলির ভিত্তি গড়ে ওঠে।
সুতরাং মোনবতার সেবায় নিয়োজিত কোন সভ্যতাকে ইসলাম কবে কোথার বিরোধিতা করেছে?
আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি ইসলামের মনোভাব কি? অতীতের প্রতিটি সভ্যতার প্রতি ইসলামের যে মনোভাব ছিল বর্তমানের পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতিও তার সেই একই রূপ মনোভাব। এসব সভ্যতার মহৎ অবদানগুলিকে ইসলাম গ্রহণ করেছে, আর ক্ষতিকর দিকগুলিকে করেছে বর্জন। বৈজ্ঞানিক বা জড়বাদী বিচ্ছিন্নতাবাদের নীতি ইসলাম কখনই সমর্থন করেনি। ব্যক্তিগত বা বর্ণগত বিবেচনায় ইহা কখনো অন্যান্য সভ্যতার বিরোধিতা করে নি; কারণ মানবজাতির ঐক্য এবং বিভিন্ন বর্ণ ও গোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কে ইহা বিশ্বাস করে। ইসলামী আদর্শ আধুনিক আবিষ্কারের বিরোধিতা করে না। এমনও কোন কথা নেই যে, বাড়ীতে, কারখানায় বা ফার্মে কোন কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হলে তার উপরে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ লিখে নিতে হবে। সেই সব যন্ত্রপাতি বা কলকব্জা যদি আল্লাহ্ নামে আল্লাহর আদর্শে ব্যবহৃত হয় তবেই যথেষ্ট হবে। আসলে যন্ত্রপাতি ও কলকব্জার তো কোন ধর্ম নেই, দেশও নেই–কিন্তু তার ব্যবহারের পদ্ধতিই পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ করে থাকে। যেমন, বন্দুক একটি আবিষ্কার মাত্র; এর কোন ধর্ম, বর্ণ বা দেশ নেই। কিন্তু আপনি যদি ইহা অন্যান্যদের বিরুদ্ধে হামলার কাজে ব্যবহার করেন, তবে আপনি মুসলিমের কাজ করতে পারলেন না। বন্দুক শুধু আক্রমণ প্রতিরোধ এবং বিশ্বে আল্লাহর বাণী প্রসারের কাজে ব্যবহৃত হোক- ইহাই ইসলামের দাবী।
চলচ্চিত্রও একটি আধুনিক আবিষ্কার। আপনি সৎ মুসলিম হতে পারেন যদি একে সুস্থ আবেগ ও মহৎ চরিত্রের চিত্রায়ন এবং মহৎ মানবতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানুষে মানুষে সংঘাত রূপায়ণে একে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি যৌন অশ্লীলতা, বেপরোয়া কুপ্রবৃত্তি অথবা নৈতিক, আধিমানসিক ও আধ্যাত্মিক অনাচার চিত্রায়নে একে ব্যবহার করেন তবে আপনি মুসলিমের কাজ করলেন না। এসব চলচ্চিত্র খারাপ ও ক্ষতিকর। শুধু এজন্যে নয় যে, এগুলো মানুষের মধ্যে কুৎসিৎ কামনা ও মানসিকতা জাগিয়ে তোলে, বরং এজন্যেও যে, এতে করে জীবনকে খুব সস্তা ও তুচ্ছ হালকামীতে পরিপূর্ণ একটি সত্তা বলে দেখানো হয়। মানবতার বিকাশে এরা কোন সুস্থ খোরাকই যোগাতে পারে না। মানুষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে যেসব অবদান রেখেছে তা গ্রহণে ইসলামী আদর্শ কখনো বিরোধিতা করেনি। সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সদ্ব্যবহার করা মুসলমানদের উচিত। রসূল (সা) বলেছেন: “বিজ্ঞান সাধনা একটি পবিত্র বিধান।” একথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, উপরে উল্লিখিত বিজ্ঞান সাধনার অর্থ সর্বপ্রকার জ্ঞান সাধনা। সর্বত্র সর্বপ্রকার জ্ঞান সাধনার জন্য রসূল (সা) মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন।
উপসংহারে বলা চলে সভ্যতা যতক্ষণ পর্যন্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকে, ইসলাম তার বিরোধিতা করে না। কিন্তু সভ্যতার অর্থ যদি হয় মদ্যপান, জুয়া, বেশ্যাবৃত্তি, উপনিবেশবাদ এবং বিভিন্ন ছুতায় মানুষকে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা, তা হলে ইসলাম অবশ্যই এ ধরনের তথাকথিত সভ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে এবং এর মায়া-মরীচিকার কবল থেকে মানবতাকে রক্ষার জন্য সম্ভবপর সকল কর্মপন্থা গ্রহণ করবে।