এই মুহুর্তে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও আবেগাপ্লুত। আল্লাহর ‘দরবারে লাখো শোকর যে, আজকের এই মুবারক মজলিসের মাধ্যমে আমার দশ দিনব্যাপী বাংলাদেশের সফরের শুভ পরিসমাপ্তি ঘটছে। সেই সাথে আজকের এই মজলিসে ‘খিদমতে খালক’ প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।
প্রথমে আমি উপস্থিত লেখক বুদ্ধিজীবীদের, আমার সহকর্মী ও স্বগোত্রীয় বন্ধুদের খিদমতে একটি কথা আরয করতে চাই। সমগোত্রীয় এ জন্য যে, আমিও আপনাদের মতো লেখাপড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট।
আপনাদের সামনে একটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন কিংবা একটি ধাঁধাঁ তুলে ধরতে চাই। আপনারা অবশ্যই জানেন হিজরি সাত শতকের মাঝামাঝি সময়ে একটি নতুন শক্তিরূপে তাতারীদের অভ্যুদয় ঘটেছিল। বর্বর তাতারীরা মধ্য এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ এলাকায় বসবাস করতো। তাদের রটেছিল বুরি তাতারীরা সংস্কৃতির পরিমন্ডল ছিল খুবই সংকীর্ণ। হাজার বছর ধরে বন্ধ জলাশয়ের মাছের মতো বিছিন্ন জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর এক সময়ে আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ ঘটলো। বর্বর তাতার জাতি তাদের সংকীর্ণ পরিবেষ্টন ভেঙে-চুরে এক দুর্বার গতিতে বেরিয়ে এলো। তখনকার ইসলামী সালতানাত বা মুসলিম সাম্রাজ্য ছিল সুদূর বিস্তৃত। বিশেষতঃ তুর্কিস্তানের খাওয়ারিজম শাহের সালতানাত ছিল তৎকালীন আলমে ইসলামীর বিশালতম সালতানাত। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি মূলে পচন ধরে গিয়েছিল। সমাজের অধিকাংশ লোক অপরাধে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। সম্পদ ও ক্ষমতা এবং বস্তুসভ্যতা ও সংস্কৃতির চোরা পথে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তাদের মধ্যে। পক্ষান্তরে সভ্যতার আলো বঞ্চিত তাতারীরা ছিল একটি প্রাণবন্ত জাতি। নবুয়তী পথ নির্দেশনা ও আসমানী শিক্ষার সাথে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না সত্য, তবে তাদের জাতীয় চরিত্রে এমন কোনো ব্যাধিও ছিল না যা তাদের জাতীয় শক্তি ও উদ্যমে অবক্ষয় সৃষ্টি করতে পারে কিংবা অলস ও বিলাসী জীবনের প্রতি আসক্ত করে তুলতে পারে।
এমন একটি প্রাণবন্ত জাতি যখন খাওয়ারিজম সালতানাতের উপর আক্রমণ চালায় তখন খাওয়ারিজম শাহের সুশিক্ষিত বিশাল সেনাবাহিনী সে আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে পারলনা। মোট কথা তাতারীদের মুকাবিলা ছিল এক জরাগ্রস্ত সালতানাত ও অপরাধাসক্ত জাতির সাথে। ফল এই দাঁড়ালো যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সমন্বয়ে যে সালতানাত আলমে ইসলামের বৃহত্তম শক্তিতে পরিণত হয়েছিল তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। খাওয়ারিজম সালতানাতের পতনের পর আলমে ইসলামীতে এমন কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট ছিল না যারা তাতারীদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও রুখে দাঁড়াতে পারে।
মুসলিম উম্মাহ তখন এমন হীনবল ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তাতারীদের মনে করা হতো আসমানী মুসীবত এবং প্রায় প্রবাদ বাক্যের মতো একথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, “সব কিছুই বিশ্বাস করতে পারো, তবে কেউ যদি বলে যে তাতারীরা মার খেয়েছে, তবে সে কথা কিছুতেই বিশ্বাস করোনা। কেননা আকাশ ভেঙে পড়া সম্ভব কিন্তু তাতারীদের পরাজিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব।” এই ছিল সমসাময়িক আলমে ইসলামীর বাস্তব চিত্র।
বন্ধুগণ, হয়তো কিছুটা বিরক্তি বোধ করছেন যে আলেম ও বিজ্ঞজনদের এই ভাবগম্ভীর মজলিসে অসভ্য তাতারীদের প্রসঙ্গ টেনে আনার কী প্রয়োজন ছিল? বন্ধুগণ, একটি বিশেষ প্রয়োজনেই তাতারীদের প্রসঙ্গ আমি এখানে টেনে এনেছি। অনুগ্রহ করে আমাকে একটুখানি সময় দিন।
ইতিহাসের এক বড় জিজ্ঞাসা এই যে, যে তাতারী জাতি এক সময়ে গোটা আলমে ইসলামীকে পিষে মেরেছিল, সুদীর্ঘ ছয়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী হারুনুর রশীদের বাগদাদকে বর্বরতায় কবরে পরিণত করেছিল, দজলা নদীর পানি একবার মুসলমানদের রক্তে লাল আর একবার লক্ষ-লক্ষ গ্রন্থের কালিতে নীল হয়ে গিয়েছিল, সেই জাতি কোন আশ্চর্য উপায়ে অকস্মাৎ জাতীয়ভাবে ইসলাম গ্রহণ করে বসলো। এক সময়ে আলমে ইসলামীতে জন্য যারা ছিল মূর্তিমান অভিশাপ, পরবর্তী কালে তারাই হলো ইসলামের (মুহাফিজ) রক্ষক। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? কি কি কার্যকারণ এর পিছনে সক্রিয় ছিল? কোন উর্ধ্ব শক্তি ইসলামের সামনে এমন একটি নিষ্ঠুর ও শক্তি মদ-মত্ত জাতির মাথা নত করে দিয়েছিল? ইতিহাসের এটা একটা প্রশ্ন যার বস্তুনিষ্ঠ উত্তর আমাদের খুঁজে পেতে হবে। এ অভাবনীয় ঐতিহাসিক ঘটনার পিছনে মূল কারণ ছিলো দু’টি :
প্রথমতঃ ইসলামী উম্মাহর অলী ও আধ্যাত্মিক বুযুর্গগণ তাতার জাতির প্রতি তাদের তাওয়াজ্জুহ ও মনযোগ নিবন্ধ করলেন। আল্লাহর দরবারে তারা প্রার্থনার হাত তুললেন। শেষ রাতে ব্যথিত ও হৃদয়ের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দিলেন। হিকমত ও মহব্বত এবং প্রেম ও প্রজ্ঞার সাথে ইসলামের দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। আহলুল্লাহ ও আল্লাহর ওলীদের উপরোক্ত কর্ম তৎপরতার একটি দৃষ্টান্ত জনৈক ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক তার The preaching of Islam নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আমি আমার তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমত গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে তা বিবৃত করেছি। অন্য একটি কার্যকারণও এর পিছনে সক্রিয় ছিল। সেই কার্যকারণটির সাথেই আজকের মজলিসের সম্পর্ক, আর এজন্যই শুধু এ মজলিসে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি।
দ্বিতীয়তঃ শক্তির সব কয়টি উপায় উপকরণই তাতারীদের কাছে মজুদ ছিল। সামরিক শক্তি তথা মার্শাল স্পিরিটের কোনো কমতি ছিল না। শৌর্য বীর্য ও রণকৌশলেও তারা অভ্যস্ত ছিল পুরোমাত্রায়। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তাদের দৈন্য ছিল চরম। কোনো লিটারেচার বা সাহিত্য ছিল না তাদের কাছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতিরও কোনো ধারণা ছিল না তাদের। ছিল না কোনো উন্নত আইন ব্যবস্থা। যাযাবর জাতির মত গুটিকতক উদ্ভট আইন কানুন ছিল তাদের সমাজ ব্যবস্থার বুনিয়াদ। এমন কি যে ভাষায় তারা কথা বলতো সে ভাষার কোনো হস্তাক্ষর পর্যন্ত ছিল না তাদের কাছে। এক কথায় সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উদার উপহারে সমৃদ্ধ মুসলিম ভুখন্ডের উপর যখন তাতারীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো তখন তারা একেবারেই শূন্যহস্ত ছিল। তাদের কাছে না ছিল ভাষা ও সাহিত্য, না ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতি, আর না ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ন্যূনতম অনুশীলন। মুসলিম লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়কগণ এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলেন। তারা তাদেরকে সাহিত্য দিলেন, কাব্য দিলেন, সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করালেন, আর শিখালেন জ্ঞান বিজ্ঞানের অনুশীলন। এভাবে গোটা তাতার জাতির ভেতর মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হলো। ফলে ধীরে ধীরে গোটা জাতি ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিল। অর্থাৎ একদিকে আল্লাহর ওলী ও প্রিয় বান্দাগণ প্রেম ও ভালোবাসা এবং ইখলাস ও নিঃস্বার্থতা দিয়ে তাতার জাতির হৃদয় জয় করলেন, অন্যদিকে মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও চিন্তা নায়কগণ তাদের মস্তিষ্ক জয় করে নিলেন। এর অর্থ এই দাঁড়ালো যে, তলোয়ার কিংবা অস্ত্রের ধারই কোনো জাতির উপর, কোনো জাতির জন্য বিজয় লাভের একমাত্র পথ নয়। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রধান্য লাভের মাধ্যমে একটি জাতিকে অতি সহজেই গোলাম বানানো যেতে পারে। আর রাজনৈতিক গোলামীর চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক গোলাম কোনো অংশেই কম নয়।
আমি আপনাদের একথাই বলতে চাই যে, সাংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে যে জাতি অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত সে জাতির অস্তিত্ব সর্বদাই বিপদ ও হুমকির সম্মুখীন। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে দেউলিয়া জাতি কোনোদিন সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারে না। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দেউলিয়া জাতি অন্যের আদর্শ ও মূল্যবোধই জীবনের সকল ক্ষেত্রে গ্রহণ করবে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদের ধর্মমতও গ্রহণ করে বসবে। মানব জাতির ইতিহাসে এমন উত্থান পতনের ভুরি ভুরি নযীর রয়েছে।
আপনাদের খিদমতে আমি আরয করতে চাই যে, আল্লাহ পাক আপনাদেরকে দেয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করেননি। নয় দশদিনের এ সংক্ষিপ্ত সফরে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত কাথবীর অধিকাংশ দেশ ভ্রমণকারী একজন সচেতন পর্যটকের দৃষ্টি নিয়ে এ জাতিকে আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে আমার এ প্রতীতি জন্মেছে যে, মেধা ও বুদ্ধিমত্তা, সরলতা ও কষ্ট সাহষ্ণুতা এবং প্রেম ও হৃদয়ের উষ্ণতার দিক থেকে এ জাতি পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির চেয়ে পিছিয়ে নেই। এ জাতির মেধা ও বুদ্ধিমত্তা যেমন স্বচ্ছ, প্রেম ও ভালোবাসাও তেমনি গভীর ও নিখাদ। কিন্তু সেই সাথে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, যদি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে আপনারা কোনো জাতি কিংবা শ্রেণীর প্রভাবাধীন হয়ে পড়েন তবে অত্যন্ত দুঃখের সাথেই আমাকে এ কথা বলতে হবে যে, জাতি হিসাবে যে কোনো মুহুর্তে আপনাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অর্জনও অপরিহার্য। এ ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতাও অর্থহীন হয়ে পড়ে। নিজেদের নেতৃত্ব নিজেদের হাতেই থাকা উচিত। আমি অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলছি অন্য কোনো দেশের, এমন কি আপনাদের স্বভাষী, যারা কোনো প্রতিবেশী দেশে বাস করে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক গোলামী করা উচিত নয়। সর্বক্ষেত্রে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন সত্তা সমুন্নত রাখুন। আর্থিক মাশুলের মত বুদ্ধিবৃত্তিক মাশুলও মানুষকে আদায় করতে হয়। আর তা আর্থিক মাশুলের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর ও বেদনাদায়ক।
অতএব নিজেদের বৃদ্ধিবৃত্তিক মাশুল নিজেদের দেশেই আদায় করুন। নিকটতম দেশ কিংবা শহরেও তা পাচার হতে দেয়া উচিত নয়। এদেশের অর্থ-সম্পদ বাইরে পাচার হয়ে যাওয়া যেমন ক্ষতিকর, বাইরের কোনো সমাজ থেকে চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা পাচার হয়ে আসাও তেমনি ক্ষতিকর। হ্যাঁ একমাত্র ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হারামাইন শরীফাইন থেকে ভাব, চিন্তা ও পথ নির্দেশনা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রয়োজন হলে উপমহাদেশীয় আধ্যাত্মিক ও শিক্ষা কেন্দ্রগুলো থেকেও চিন্তা ও বৃদ্ধিভিত্তিক পাথেয় সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু চিন্তা, বিশ্বাস এবং ঈমান ও আকীদার ক্ষেত্রে যাদের সাথে মৌলিক বিরোধ রয়েছে, সাহিত্য, কাব্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ খুবই মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।
দু’টি পথে তাতারী জাতি ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। প্রথমতঃ অধ্যাত্মিক, দ্বিতীয়ঃ বুদ্ধিবৃত্তিক। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমানরা ছিল তখন শীর্ষ জাতি। মৌলিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তারা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আজকের ইউরোপ তখন ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। একাডেমিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব তখন এককভাবে মুসলমানদের হাতেই ছিল। সামরিক ও রাজনৈতিক বিচারে যদিও তারা ছিল বিজিত; কিন্তু বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে তারাই ছিল বিজেতা আর তাতারীরা ছিল বিজিত। ফলে ইতিহাসের আমোঘ নিয়মে বিজয়ী জাতিকে মাথা নত করতে হয়েছিল বিজিত জাতির কাছে। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে আজ আমার সে আশঙ্কাই হচ্ছে। এক হিতাকাংখী ও কল্যাণকামী বন্ধু হিসাবে আপনাদের জন্য আমার পরামর্শ এই যে, নিজেদের সাহিত্য কাব্য নিজেরাই গড়ে তলুন। সংস্কৃতি ও শিল্পের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্টাইল ও রীতি গ্রহণ করুন এবং তার উৎকর্ষ সাধনে একনিষ্ঠ ও নিবেদিত হোন। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলছি, জাতীয় কবি হিসাবে কবি নজরুল ইসলামকেই আপনাদের তুলে ধরা উচিত। নজরুলের কাব্য ও সাহিত্যকর্ম বিশ্ব-সাহিত্য সভায় তুলে ধরুন এবং নজরুলকে নিয়ে গর্ব করুন। আপনাদের নিজেদের ভিতরের অনেক প্রতিভা লুকিয়ে আছে সেসব প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করুন। নিজেদের ভিতর থেকেই স্টাইলের জন্য দিন। নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিজেরাই নিজেকে করুন। মনে রাখবেন, এটা খুবই সংবেদনশীল ক্ষেত্র। এখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। সংস্কৃতির জগতে আপনাদেরকে পূর্ণ স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। ইতিহাসের একজন সাধারণ ছাত্র হিসাবে বলছি, এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। আর ইতিহাসের প্রতিশোধ বড় নির্মম।
যে কারণে আপনাদেরকে দেশ থেকে আমি আনন্দ ও আশাবাদ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি তা হচ্ছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপস্থিতি। বস্তুতঃপক্ষে এটা হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক দিকে একটি সঠিক পদক্ষেপ। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন জাতির জন্য নিজস্ব একাডেমি থাকা একান্তই অপরিহার্য। চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎস স্বদেশের মাটিতে থাকাই উচিত, এটা নিজেদের জন্য মর্যাদাজনক ও কল্যাণকর হয়। হিন্দুস্থান ও মিশরের মুসলমানগণ পাশ্চাত্য সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া এবং ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ শুধু এই যে, তাদের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার উৎস ছিল ইউরোপ, কেম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড কিংবা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। বাইরে থেকে আপনারা যা খুশি আমদানি করুন। খাদ্য আমদানি করুন, বৈজ্ঞানিক উপকরণ, কলকব্জা ও কারিগরিবিদ্যা আমদানি করুন। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন ও আদর্শ আমদানি করা বন্ধ করুন। বাংলাদেশের মত স্বাধীনচেতা জাতির জন্য নিজস্ব স্টাইল থাকা উচিত। সর্বক্ষেত্রে নিজস্ব স্টাইল ও রীতির প্রচলন হওয়া উচিত। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ আপনাদের অনুসরণ করুক। আপনারা তাদের অনুকরণ করতে যাবেন না। সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে আপনারা ইমাম হোন। সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের অধিকারী কোনো স্বাধীন জাতির জন্য মুকতাদী হওয়া গর্বের কথা নয়। আপনাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব ইতিহাস। আপনাদের পক্ষে অন্য কোনো জাতির দুয়ারে, আয়তন ও সংখ্যায় তারা যত বড়ই হোক, ধর্ণা দেয়া শোভনীয় নয়। প্রথম কাতারে নিজেদের অবস্থান মজবুদ করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থান আপনাদের জন্য নয়। শিক্ষা, দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প-কাব্য, এক কথায় বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে যতদিন আপনারা আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন না করবেন, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অবস্থান মজবুত করতে সক্ষম না হবেন, ততদিন আশ্বস্ত হওয়ার কোনো উপায় নেই। একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় আশা-আকাংখা ও মূল্যবোধের সাথে অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
আরেকটি কারণেও আমার মনে আজ আনন্দ ও আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে। সেটি এই যে, বিলম্বে হলেও খিদমতে খালক বা আর্তমানবতার সেবার গুরুত্ব আপনারা অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং সেজন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। গতকাল সোনারগাঁয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার সেবা, কার্যক্রম ও যাবতীয় ব্যবস্থা অবলোকন করে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। স্টাফ ও স্থানীয় লোকজনদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমি আলাপ করেছি। গড়ে প্রতিদিন কতজন রুগী আসে, কতজন রুগীকে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়, কী পরিমাণ ঔষধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় ইত্যাদি বিষয়ে অবগত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সত্যি এটা আল্লাহর বিরাট মেহেরবানী। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ক্ষেত্রের দিক দিয়ে বিলম্বে হলেও আপনারা নজর দিয়েছেন। যা এতোদিন খৃষ্টান মিশোনারীদের একচেটিয়া ময়দান মনে করা হতো।বস্তুত আর্তমানবতা সেবার ছদ্মাবরণেই তারা এদেশের সাধারণ মানুষের সহানুভূতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বত্র আজ এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, মিশনারী হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো অন্যান্য হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রের তুলনায় আদি হাসপাতাল সেবাধর্মী। যেহেতু তাদের মধ্যে মিশনারী মনোভাব থাকে সেহেতু চিকিৎসা প্রার্থীদের সাথে তারা অত্যন্ত কোমল ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করে থাকে। ফল এই দাঁড়ায় যে, মানুষ সেখানে শারীরিক সুস্থতা লাভ করলেও তার আত্মা হয়ে পড়ে অসুস্থ ও রোগগ্রস্ত। অন্তত এ ধারণা নিয়ে তাকে ফিরে আসতে হয় যে, আমাদের চেয়ে এরা অনেক ভালো লোক। এদের মধ্যে মানবতাবোধ আছে। আছে সহানুভূতিপূর্ণ কোমল হৃদয়। এটাই এক ধরণের রোগ। একটি রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে আরো মারাত্মক ও ক্ষতিকর আরেকটি রোগ নিয়ে সে বাড়িতে ফিরে আসে। তাই আমি মনে করি যে, এই মুহুর্তের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো আর্তমানবতার সেবায় গোটা জাতির আত্মনিয়োগ করা। যাতে মানুষ নিজের ঈমান ও বিশ্বাসের হিফাজত করে সহজ উপায়ে সঠিক চিকিৎসা কিংবা অন্ততপক্ষে সহৃদয় পরামর্শ লাভ করতে পারে। এই মহান প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি ও আমার সফর সঙ্গীরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। শুধু এ কথাই আমি আপনাদের বলবো যে, প্রথমতঃ শুধু আল্লাহর সন্তষ্টি ও রেজামন্দি লাভই যেন হয় আপনাদের যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন ও কর্মকান্ডের মূল উদ্দেশ্য হয়। এ বিশ্বাস রাখবেন যে, আপনারা ইবাদতে নিয়োজিত আছেন। আমি আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি বরং আমার ফতোয়া এই যে, আপনারা ইবাদতে এবং সর্বোত্তম ইবাদতে নিয়োজিত আছেন।
কেননা হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে: দুনিয়াতে যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের কষ্ট লাঘব করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তার কষ্ট লাঘব করে দিবেন। আরো ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ পাক ততক্ষণ বান্দার সাহায্যরত থাকে না যতক্ষণ না বান্দা তার মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যরত থাকে। হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে: কিয়ামতে আল্লাহ পাক একদল লোককে লক্ষ্য করে বলেন; আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসনি।” তারা বলবে: হে মহামহিম আল্লাহ! আপনি কিভাবে অসুস্থ হতে পারেন? ইরশাদ হবেঃ আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। যদি তাকে দেখতে যেতে তবে আমাকেও সেখানে দেখতে পেতে। বলুন এর চেয়ে বড় মর্যাদার বিষয় আর কী হতে পারে! দ্বিতীয়তঃ সেবা ও চিকিৎসার সাথে প্রেম ও সহানুভূতিও যোগ করতে হবে। তবেই এ বিরাট পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা সার্থকতা লাভ করবে। এই দুর্বল মুহুর্তে মানুষের হৃদয়ের কোমল মাটিতে ঈমান ও কল্যাণের বীজ বপন করে দিন। ইনশাআল্লাহ্ কোনো একদিন তা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে। অন্ততপক্ষে এ বিশ্বাস তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে, আল্লাহই হচ্ছেন শেফাদানকারী। ওষুধ ও চিকিৎসক উপলক্ষ মাত্র। আল্লাহর নির্দেশেই ওষুধ তার ক্রিয়া করে। ওষুধের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। এর পর যখন রোগী শেফা লাভ করবে তখন তার অন্তরে নূর সৃষ্টি হবে। তার বিশ্বাসের ভিত মজবুত হবে। আপনাদের সকলকে বিশেষ করে সভাপতি সাহেব ও ফাউন্ডেশন কর্মকর্তাদেরকে আমার আন্তরিক মুবাবরকবাদ। একটি সঠিক ও নির্ভুল ক্ষেত্র আপনারা নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছেন। আপনাদের এ দূরদর্শিতা দেশ ও জাতির জন্য প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে। এটা শুধু দেশের খিদমত নয় দ্বীনেরও এক বিরাট খিদমত। আল্লাহ পাক এ প্রকল্পটিকে স্থায়িত্ব ও পূর্ণতা দান করুন।
সাথে সাথে আপনাদেরকে একথাও বলবো যে, অমুসলিম ভাইদের সাথেও সমান আচরণ করুন। এ ক্ষেত্রে ধর্ম বিশ্বাসের প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে যে, এরাও আল্লাহর বান্দাহ, আল্লাহই এদের সৃষ্টি করেছেন। এদের কোনোরূপ কষ্ট লাঘব করতে পারলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং আমরা উত্তম বিনিময় লাভ করবো। সেবার ক্ষেত্রে মুসলমান অমুসলমানের পার্থক্য করা উচিত হবে না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অমুসলিম ভাইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মোট কথা, আপনার চিকিৎসা সহায়তা নিতে এসে তারা যেন কোনো রকম দ্বৈত আচরণ অনুভব করতে না পারে। আমাদের বোনেরাও সেবার ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাদের কোমল হৃদয় এক মূল্যবান সম্পদ। এমন কিছু তারা করতে পারেন যা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের হিন্দুস্থানে এবং এখানেও সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমার বোনেরাও পর্দার পিছনে থেকে আমার কথাগুলো শুনছেন জানতে পেরে আমি আনন্দিত হয়েছি। আল্লাহপাক তাদেরকে সমাজ সেবায় যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করার তাওফীক দান করুন।
শ্রদ্ধেয় বন্ধুগণ, আরেকটি বিষয় আরয করেই আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। আমি আপনাদেরকে মিশর বিজয়ী সাহাবী হযরত আমর ইবন আসের একটি ঐতিহাসিক বাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তখনকার দুনিয়ায় মিশরের অবস্থান ছিলো তাহযীব তামাদ্দুন ও সভ্যতার স্বর্ণ শিখরে। নীল নদী বিধৌত মিশর ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুজলা শস্য শ্যামল ভূখন্ড। এমন একটি সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত দেশ জয় করার পরও কেন জানি হযরত আমর ইবন আস স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। একজন বিজয়ী সেনাপতির মনে যে স্বাভাবিক পুলক অনুভূত হয় তার লেশ মাত্রও ছিল না তার অন্তরে।
কেননা তিনি ছিলেন নবীর সান্নিধ্য প্রাপ্ত এক সাহাবী। কুরআনের শিক্ষা এবং নবুয়তের দীক্ষায় তার অন্তর ছিল আলোক উদ্ভাসিত। তিনি ছিলেন যুগপৎ ঈমানী প্রজ্ঞা এবং সাহাবী সুলভ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। তাই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সুদূর ভবিষ্যত পানে। বিজয়ী আরব মুসলমানদের ডেকে তিনি ঘোষণা করলেন তার সেই ঐতিহাসিক বাণী; যা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। আরব বিজয়ীদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন: “মনে রেখো, মিশরের সবুজ শ্যামল উর্বর মাটি, মিশরের সম্পদ ভান্ডার ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এদেশের তাহযীব তামাদ্দুন তোমাদের মনে যেন মোহ সৃষ্টি করতে না পারে। এদেশের প্রাকৃতিক রূপ ও জৌলুসে তোমরা যেন আত্ম-বিমোহিত হয়ে না পড়। এখানে তোমাদের সঠিক অবস্থান ও দায়িত্ব সম্পর্কে সর্বক্ষণ সজাগ থেকো। মনে রেখো, তোমরা এখানে সার্বক্ষণিক প্রহরায় নিয়োজিত আছ। এক গুরুত্বপূর্ণ চৌকিতে তোমরা অবস্থান করছো। একথা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করোনা যে, তোমরা কিবতীদের উপর বিজয় লাভ করেছ। কিংবা রোম সাম্র্যাজের শস্যভাণ্ডার দখল করে নিয়েছো। একথাও মনে করোনা যে, আরব উপদ্বীপ খুব নিকটে। কোনো অবস্থাতেই আত্মপ্রতারণার শিকার হয়োনা। এমন এক নাজুক জায়গায় তোমরা আছ যে, মুহূর্তের অসাবধানতায় তোমাদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি মুহূর্ত তোমাদেরকে সজাগ সতর্ক থাকতে হবে। এক ঐশী বাণীর ধারক, বাহক ও প্রচারক হয়ে তোমরা এদেশে এসেছ। মুহূর্তের গাফিলতি ও দায়িত্ব বিচ্যুতি তোমাদের এ বিজয়কে ধূলি লুন্ঠিত করে দিতে পারে। সেই জীবন দর্শন থেকে চুল পরিমাণও যদি বিচ্যুত হও, যা তোমরা মদীনার পূণ্য মাটিতে নবুয়তের পবিত্র সাহচর্যে লাভ করেছ তা ততামাদের প্রাধান্য বিলুপ্ত হবে এবং মিশরে যারা আজ তোমাদের এ বিজয়কে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাগত জানিয়েছে তারাই সেদিন তোমাদের বুক লক্ষ্য করে তরবারি উচিয়ে ধরবে। এদেশবাসী তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র করুণা করবে না। একটি প্রাণীও সহী সালামতে ফিরে যেতে পারবেনা।”
প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে এক আরব সৈনিক, যিনি কোনো ইউনিভার্সিটির স্কলার ছিলেন না, বিজয়ী আরবদের লক্ষ্য করে যা বলেছিলেন তা আজ এই মুহূর্তে ইসলামী বিশ্বের বিশেষত আপনাদের এদেশের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।
বন্ধুগণ, আপনাদেরও মনে রাখতে হবে, আপনারা সার্বক্ষণিক প্রহরায় নিয়োজিত আছেন। মুহূর্তের অসাবধানতা আপনাদের ঈমান, বিশ্বাস ও স্বাধীনতা বিপন্ন করে দিতে পারে।
বাংলা ভাষার নেতৃত্ব গ্রহণ করা উলামায়ে কেরামের কর্তব্য
(১৯৮৪ সালের ১৪ মার্চ কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া প্রাঙ্গনে বিশিষ্ট আলেম, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে মাওলানা নদভীর প্রদত্ত ভাষণ।)
উপস্থিত উলামায়ে কেরাম, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আমার প্রিয় বন্ধুগণ,
আপনাদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে দেশ জাতির প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা। আপনারা এ জাতির ঈমান ও বিশ্বাসের অতন্দ্র প্রহরী, ইসলামের সাথে এ দেশের সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই যেন বিন্দুমাত্র শিথিল না হয় সে ব্যাপারে আপনাদেরকে পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে। যে দেশ এবং যে জাতির জন্য আল্লাহপাক আপনাদের নির্বাচিত করেছেন তাদের ব্যাপারে অবশ্যই আপনাদেরকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামের সাথে এ দেশের সম্পর্ক যদি বিন্দুমাত্র শিথিল হয় কিংবা অনৈসলামী কার্যকলাপ ও ইসলাম বিরোধী তৎপরতা শুরু হয় তবে মনে রাখবেন, রাসূলের ওয়ারিছ ও উত্তরাধিকারী হিসাবে আপনাদেরকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। রাজনৈতিক কর্ণধাররা জিজ্ঞাসিত হবে কিনা এ প্রশ্ন এখানে নয়। কিন্তু এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, সর্বপ্রথম আলেমদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হবে। তোমাদের চোখের সামনে আমার রেখে আসা দ্বীনের এমন অসহায় অবস্থা কিভাবে হতে পারলো? কোন মুখ নিয়ে আজ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ? প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহ বলেছিলেন- আমি বেঁচে থাকতে দ্বীনের কোনো অঙ্গহানী ঘটবে এটা কী করে হতে পারে?
এই মূহুর্তে আপনাদেরকে খুঁটিনাটি মত পার্থক্য সিকায় তুলে রেখে এক বৃহত্তর ও মৌলিক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটে নিপতিত জাতির এই মুহূর্তে আপনাদের ঐক্যবদ্ধ পথ নির্দেশনার বড় প্রয়োজন। ইখলাছ ও আত্মত্যাগ এবং প্রেম ও নিঃস্বার্থতা দিয়ে জাতির সেই অংশটিকে প্রভাবিত করুন যাদের হাতে দেশ শাসনের ভার অর্পিত হয়েছে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে যাদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হতে যাচ্ছে। এ যুগে শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য অপরিহার্য জ্ঞান, দক্ষতা ও উপকরণ যাদের হাতে রয়েছে, জাতির সে অংশটির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা আপনাদের অপরিহার্য কর্তব্য। তাদেরকে তাদের ভাষায় বোঝাতে হবে। আপনাদের যে, আপনারা নিঃস্বার্থ এবং কলাবিকামী। তাদের কাছে যেন আপনাদের কোনো প্রত্যাশা না থাকে, বিভিন্ন প্রলোভন কলমেকাসুবিধার কথা হয়ত বলা হবে। এ এক কঠিন অগ্নি-পরীক্ষা। নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর তখন অটল-অবিচল থাকতে হবে। কেননা আপনাদের বিনিময় আল্লাহর হাতে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টির দিকে আমি আপনাদের সযত্ন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলো, এ দেশের ভাষাকে (বাংলা ভাষা) আপনারা অস্পৃশ্য মনে করবেন না। বাংলা ভাষা ও তার আদিত্য চর্চায় কোনো পূণ্য নেই, যত পূণ্য সব আরবী আর উর্দুতে-এ ধারণা বর্জন করুন। সাহিত্যচর্চায়তা। আপনারা নিজেদেরকে বাংলা ভাষার বিরল প্রতিভারূপে গড়ে তুলুন। আপনাদের প্রত্যেককে হতে হবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, সাহিত্যিক, সুবক্তা। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আপনাদের থাকতে হবে দৃপ্ত পদচারণা, লেখনী হতে হবে রস- সিক্ত ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারী। যেন আজকের ধর্ম বিমুখ শিক্ষিত তরুণ সমাজও অমুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের লেখনী ছেড়ে আপনাদের সাহিত্য কর্ম নিয়েই মেতে ওঠে, বিভোর হয়ে থাকে।
দেখুন, একথা আপনারা লাখনৌর অধিবাসী, উর্দু ভাষার প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং আরবী ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী এক ব্যক্তির মুখ থেকে শুনছেন। আল-হামদুলিল্লাহ। আমার বিগত জীবন আরবী ভাষার সেবায় কেটেছে এবং আল্লাহ চাহেন বাকি জীবনও আরবী ভাষার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। আরবী ভাষা আমাদের নিজেদের ভাষা। বরং আমি মনে করি যে, আরবী আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের কথা থাকুক, আল্লাহর শোকর আমার বংশের অনেক সদস্য এবং আমাদের অনেক ছাত্রের সাহিত্য প্রতিভাও খোদ আরবী সাহিত্যিকদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
বন্ধুগণ,
উর্দু ভাষার পরিবেশে যে চোখ মেলেছে, আরবী সাহিত্যের খিদমতে যে তার যৌবন নিঃশেষ করেছে সে আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ণ দায়িত্ব সচেতনতার সাথে বলছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইসলাম বিরোধী শক্তির রহম করমের উপর ছেড়ে দেবেন না। “ওরা লিখবে আর আপনার পড়বেন” এ অবস্থা কিছুতেই বরদাস্ত করা উচিত নয়। মনে রাখবেন, লেখনীর এক অদ্ভূত প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি আছে। লেখনীর মাধ্যমে লেখকের ভাব-অনুভূতি, এমনকি তার হৃদয়ের স্পন্দনও পাঠকের মধ্যে সংক্রমিত হয়। অনেক সময় পাঠক হয়ত তা-অনুধাবনও করতে পারেনা। ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান লেখকের লেখনী পাঠকের অন্তরেও সৃষ্টি করে ঈমানের বিদ্যুৎ প্রবাহ। হযরত থানভী (রহঃ) বলতেন, পত্র যোগেও মুরীদের প্রতি তাওয়াজ্জুহ বা মনোযোগ নিবদ্ধ করা যায়। শায়খ বা পীর তাওয়াজ্জুহ সহকারে মুরীদকে লক্ষ্য করে যখন পত্র লিখেন তখন সে পত্রের অক্ষরে অক্ষরে থাকে এক অত্যাশ্চর্য প্রভাব শক্তি।
এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মাদের রচনা-সম্ভার আজও মওজুদ রয়েছে। পড়ে দেখুন, আপনার সালাতের প্রকৃতি বদলে যাবে। হয়ত পঠিত বইটির বিষয়বস্তুর সাথে সালাতের কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু তিনি যখন লিখছিলেন তখন তাঁর তাওয়াজ্জুহ ও মনোযোগ সেদিকে নিবদ্ধ ছিল। এখন আপনি তাদের লেখনী পড়ে তারপর গিয়ে সালাত আদায় করুন। হৃদয় জাগ্রত এবং অনুভতি সচেতন হলে অবশ্যই আপনি উপলব্ধি করবেন যে, আপনার সালাতের অবস্থা ও প্রকৃতি বদলে গেছে। অনেকবারই আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আপনি অমুসলমানদের লেখনী পড়বেন, তাদের রচিত গল্প, উপন্যাস ও কাব্যের রস-উপভোগ করবেন এবং তাদের লিখিত ইতিহাস নির্দ্বিধায় গলাধকরণ করবেন অথচ আপনার হৃদয়ে তার কোনো দাগ কাটবেনা, এটা কী করে হতে পারে? আপনার অবচেতন মনে হলেও ‘লেখনী’ তার নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করবেই। আমি বশ্বাস করতাম না যেটা বড় লজ্জার মাকুতেই বিশ্বাস করতাম না যে, এই সে দেশ যে দেশে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক আলেমের জন্য হয়েছে, সেখানে বাংলা হাতকারআনের প্রথম তরজমাকারী হচ্ছেন একানি হি আলেমের জন্য এদেশের মুসলিম সাহিত্যিকদেরকে বিশ্বের দরবারে আপনারা তুলেন হিন্দু সাহিত্যিক। ফররুখকে তুলে ধরুন, তাদের অনবদ্য সাহিত্যকর্মের কথা বিশ্বকে অবহিত করুন। নিবিষ্ট খুন ও গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে তাদের সাহিত্য পড়ুন, অন্যান্য ভাষায় বহিত করুন। নিবিষ্ট আল্লাহ তাওফীক দিলে আরবী ভাষায়ও তাদের সাহিত্য পেশ করুন। কারাদ পষ্টিকারী সাহিত্য প্রতিভার জন্ম এদেশে হয়েছে, তাদের কথা লিখুন, বিশ্বের কাছে তাদেরকে তুলে ধরুন। আল্লাহর রহমতে এমন কোনো যোগ্যতা বাকি নেই যা আপনাদের দেয়া হয়নি। আমাদের মাদরাসাগুলোতে এমন অনেক বাঙালি ছাত্র আমি দেখেছি যাদের মেধা ও প্রতিভার কথা মনে হলে এখনো ঈর্ষা জাগে। প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার সময় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ছাত্ররা তাদের মুকাবিলায় একেবারেই চুপসে যেতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে মানপত্র দেওয়া হয়েছে। আমার এ ধারণাই ছিল না যে, এতো সুন্দর আরবী লেখার লোকও এখানে রয়েছেন। কখনো হীনমন্যতার শিকার হবেন না। সব রকম যোগ্যতাই আল্লাহ আপনাদের দান করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এগুলোর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।
আমার কথা মনে রাখবেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে। দু’টি শক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। অমুসলিম শক্তির হাত থেকে এবং অনৈসলামী শক্তির হাত থেকে। অনৈসলামী শক্তি বলতে সেইসব নামধারী মুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের কথাই আমি বোঝাতে চাচ্ছি যাদের মন-মগজ এবং চিন্তা ও কর্ম ইসলামী নয়। মোটকথা, এ উভয় শক্তির হাত থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। এমন অনবদ্য সাহিত্য গড়ে তুলুন যেন অন্যদিকে কেউ আর ফিরেও না তাকায়। আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের হিন্দুস্তানী আলিমগণ প্রথম থেকেই এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। ফলে সাহিত্য, কাব্য, সমালোচনা ও ইতিহাস-সহ সর্বত্র আজ আলেম সমাজের দৃপ্ত পদচারণা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের উজ্জ্বল প্রতিভার সামনে সাহিত্যের বড় বড় দাবীদাররা একেবারেই নিষ্প্রভ।
একবার একটি প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় উর্দু সাহিত্য সাময়িকীর তরফ থেকে একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগীদের দায়িত্ব ছিল উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক নির্বাচন। বিচারকদের দৃষ্টিতে পুরস্কার তারাই লাভ করলেন-যারা মাওলানা শিবলী নো’মানীকে উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে প্রমাণ করেছিলেন। উর্দু সাহিত্যের উপর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন কিংবা সেমিনার হলে সভাপতিত্বের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, মাওলানা আব্দুস সালাম নদভী, মাওলানা হাবীবুর রহমান খান কিংবা মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদীকে। উর্দু কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসের উপর দু’টি পুস্তক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। সে দুটি হাে মওলভী মুহাম্মদ হুসাইন আযাদ কর্তৃক লিখিত “আবে হায়াত” এবং আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম মাওলানা সাইয়্যেদ আব্দুল হাই এর লেখা “গুলে রা’না” (কোমল গোলাপ)।
মোটকথা, হিন্দুস্তানে উর্দু সাহিত্যকে আমরা অন্যের নিয়ন্ত্রণে যেতে দেইনি। ফলে আল্লাহর রহমতে সেখানে একথা কেউ বলতে পারে না যে, মাওলানারা উর্দু জানেনা কিংবা টাকশালী উর্দুতে তাদের হাত নেই। এখনও হিন্দুস্তানী আলেমদের মধ্যে এমন লেখক, সাহিত্যিক ও অনলবর্ষী বক্তা রয়েছেন, যাদের সামনে দাঁড়াতেও অন্যদের সংকোচ বোধ হবে। বাংলাদেশে আপনাদের তাই করা উচিত। আমার কথা আপনারা লিখে রাখুন। দীর্ঘ জীবনের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন কিংবা বিমাতাসুলভ আচরণ এ দেশের আলেম সমাজের জন্য জাতি হত্যারই নামান্তর।
প্রিয় বন্ধুগণ,
আমার এ দুটি কথা মনে রাখবেন। এর বেশি কিছু আমি বলতে চাই না। প্রথম কথা হলো, এই দেশ ও জাতির হিফাযতের দায়িত্ব আপনাদের। ইসলামের সাথে এদেশের সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই যেন শিথিল হতে না পারে । অন্যথায় আপনাদের এই শত শত মকতব মাদরাসা মূল্যহীন হয়ে পড়বে। আমি সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আমার কথায় দোষ ধরবেন না। আমি মাদরাসারই মানুষ, মাদরাসার চৌহদ্দীতেই কেটেছে আমার জীবন। আমি বলছি, আল্লাহ না করুন ইসলামই যদি এদেশে বিপন্ন হলো, তবে মক্তব-মাদরাসার কোনোই যৌক্তিকতা নেই। আপনাদের পয়লা নম্বরের কাজ হচ্ছে এদেশে ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করা। ইসলামের সাথে জাতির সম্পর্ক অটুট রাখা।
দ্বিতীয় কথা হলো, যেকোনো দেশ ও জাতির নেতৃত্ব এবং সঠিক পথ নির্দেশনা নিজেদের হাতে নিতে হবে। আর তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধি-বৃত্তিক প্রাধান্য অর্জন ছাড়া কখনো সম্ভব নয়। গতকালও আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত সম্বর্ধনা সভায় বলেছি যে, আমার খুবই আফসোস হচ্ছে- আমি আপনাদের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে সক্ষম নই। আপনাদের ভাষায় আপনাদের সম্বোধন করতে পারলে আজ আমার আনন্দের সীমা থাকতো না। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ভাষাই বিদেশী কিংবা পর নয়। পৃথিবীর সকল ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি এবং প্রত্যেক ভাষারই রয়েছে নিজস্ব কতগুলো বৈশিষ্ট্য। ভাষা বিদ্বেষ হলো জাহেলিয়াতেরই উত্তরাধিকার । কোনো ভাষা যেমন পূজনীয় নয়, ঘৃণ্যও নয় । একমাত্র আরবী ভাষাই পেতে পারে পবিত্র ভাষার মর্যাদা। এ ছাড়া পৃথিবীর আর সব ভাষাই সম মর্যাদার অধিকারী। মানুষকে আল্লাহ পাক বাকশক্তি দিয়েছেন এবং যুগে যুগে মানুষের মুখের ভাষা উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিভিন্ন সোপান অতিক্রম করে বর্তমান রূপ ও আকৃতি নিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। মুসলমান প্রতিটি ভাষাকেই মর্যাদা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কেননা মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পৃথিবীর সকল ভাষাই আমাদেরকে সাহায্য করে। প্রয়োজনে যে কোনো ভাষা শিক্ষা ইসলামেরই নির্দেশ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত যায়েদ বিন সাবিতকে (রাঃ) হিব্রু ভাষা শেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ হিব্রু হচ্ছে নির্ভেজাল ইহুদী ভাষা। দেশের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা যদি উদাসীন ও নির্লিপ্ত থাকি তবে তা স্বাভাবিকভাবেই অনৈসলামিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ফলে যে ভাষা ও সাহিত্য হতে পারতো ইসলাম প্রচারের কার্যকর মাধ্যম তাই হয়ে দাঁড়াবে শয়তানের শক্তিশালী বাহন । আপনাদের এখানে কলকাতা থেকে অশ্লীল সাহিত্য আসছে। সাহিত্যের ছদ্মাবরণে কমিউনিজমের প্রচার চলছে। ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংসের মাল-মশলা তাতে মিশানো হচ্ছে। আর সরলমনা তরুণ সমাজ গোগ্রাসে তা গিলছে। এর পরিণতি কখনো শুভ হতে পারে না।
ভাইসব,
আপনারা তিরমিযী, মিশকাত কিংবা মিযানের শরাহ্ লিখতে চাইলে তা আরবী উর্দুতে লিখুন, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু জনগণকে বোঝাতে হলে জনগণের ভাষাতেই কথা বলতে হবে। আমি আপনাদের খিদমতে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই পাক ভারতে হাদীছ, তাফসীর ও ফিকাহ শাস্ত্রের উপর এ পর্যন্ত অনেক কাজ হয়েছে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যাখ্যা গ্রন্থও লেখা হয়ে গেছে। সেখানে নতুন সংযোজনের বিশেষ কিছুই নেই । আপনাদের সামনে এখন পড়ে আছে কর্মের এক নতুন বিস্তৃত ময়দান। দেশ ও জাতির উপর আপনাদের নিয়ন্ত্রণ যেন শিথিল হতে না পারে, আপনাদের দেশের মানুষ যেন মনে না করে যে, দেশে থেকেও আপনারা বিদেশী। স্বদেশের মাটিতে এই প্রবাস জীবন অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। মনে রাখবেন, এদেশের মাটিতেই আপনাদের থাকতে হবে এবং এদেশের জনগণের মাঝেই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিতে হবে। এদেশের সাথেই আপনাদের ভাগ্য, আপনাদের ভবিষ্যত জড়িত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “হে মুসলমানগণ! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের আবরু ইজ্জত পরস্পরের জন্য হারাম। ভাষাগত পার্থক্যের কারণে কোনো মুসলমান ভাইকে অপমান করা, তার ইজ্জত আবরু লুণ্ঠন করা কিংবা তাকে হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম ও জুলুম।”
“প্রতিটি বস্তুর জন্য আল্লাহ পাক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ও স্তর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোনো মুসলমানের জন্য সে সীমা লংঘন করা বৈধ নয়। সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটান ও কাব্যের রস উপভোগ করুন। কিন্তু অতিরঞ্জন করবেন না। কোরআন শরীফকেও যদি কেউ পূজা করা শুরু করে, উপাস্য জ্ঞানে তাকে সিজদা করে তবে সে মুশরিক হয়ে যাবে, কেননা ইবাদত শুধু আল্লাহরই প্রাপ্য। তবে সব ভাষাকে স্ব-স্ব মর্যাদায় রেখে মাতৃভাষাকে ভালোবাসা, স্বীয় অবদানে তাকে সমৃদ্ধ করে তোলা শুধু প্রশংসনীয়ই নয় অপরিহার্যও বটে।
বন্ধুগণ,
পরদেশী মুসাফির ভাইয়ের এ কথাগুলো যদি স্মরণ থাকে তবে একদিন না একদিন তার গুরুত্ব আপনারা অবশ্যই উপলব্ধি করবেন। “আপনাদেরকে যে কথাগুলো বলছি তা অদূর ভবিষ্যতে আপনারা স্মরণ করবেন; আমি আমার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করছি। নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দাদের সব কিছু দেখেন।”
আকাশের ফিরিশতারা শুনে রাখুক এবং “কিরামান কাতিবীন” লিখে রাখুক যে, প্রতিবেশী ভাইদের প্রতি আমি আমার দায়িত্ব পূর্ণ করেছি। আমি আবার বলছি, শেষ বারের মত বলছি, যদি আপনারা এদেশের মাটিতে বাঁচতে চান, ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চান, তবে এটাই হচ্ছে তার বিকল্প উপায়। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।
অনুবাদ – মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
(মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীর তাকিয়াকেলা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ বছর বয়সে নাজেমে নদওয়াতুল ইলামা তাঁর পিতা হযরত মাওলানা আব্দুল হাই ইন্তেকাল করলে তিনি তাঁর বিদূষী মাতা খায়রুননেসা এবং যোগ্য বড় ভাই ডাঃ আব্দুল আলী সাহেবের তত্ত্বাবধানে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায়ে লেখাপড়া শেষ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি আরবী উস্তাদগণের সাহচর্যে আরবী ভাষা এবং সাহিত্যের ময়দানে যথেষ্ট বুৎপত্তি হাসেল করেন এবং তার চিন্তাধারাকে আরব বিশ্বে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হন। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর নদুয়ায় অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সাথে সাথে দেশের বরণীয় উলামাদের সাহচর্য লাভে ধন্য হন। তিনি দেশের মাশায়েখ এবং বিশেষ করে হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের নেক দৃষ্টি লাভে ধন্য হয়ে দাওয়াতী ময়দানে দেশে এবং বিদেশে অনেক কাজ করেন। তিনি হযরত মাওলানা আহমাদ আলী এবং মাওলানা আব্দুল কাদের রায়পুরী (রহঃ) এর নিকট হতে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। হযরত মাওলানা জীবনে বহু কাজ করে গেছেন। বেশ কিছু দেশী এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারেও তিনি ভূষিত হয়েছেন। তিনি নামকরা লেখক ছিলেন। তার রচনাবলী সারা দুনিয়ায় সমাদৃত হয়েছে। তিনি ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রায়বেরেলীতে ইন্তেকাল করেন। ১৯৮৪ সালে মাওলানা বাংলাদেশ সফর করেন। সেই সময় তিনি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৪ সালের ১৯ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ আয়োজিত দেশের বুদ্ধিজীবী ও গবেষণা কাজে নিয়োজিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ।)