পয়গম্বরদের একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—সকলেই হিজরত করেছেন। সকল পয়গম্বরের জন্য এই হিজরত ছিল তাকদিরসিদ্ধ, এবং একইসাথে নবীর উম্মতদেরকেও নবীর সাথে হিজরত করতে হয়েছে। এ উসিলায় সকল পয়গম্বরের তাকদির যেন একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। যে সকল নবীর জীবনে হিজরতের ঐশী আদেশ এসেছে, তা এসেছে চূড়ান্ত পরীক্ষা ও বিজয়ের সূচনা হিসেবে।
আল্লাহ পাক তার ইবাদতের জন্য যেমন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তাদের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজেদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা, শ্রম-সাধনা এ পথে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। দিন-রাত মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথে। কিন্তু খুব কম লোকই নবী রাসূলগণের হক্বের দাওয়াতকে কবুল করেছে। অধিকাংশ লোক তাদের দাওয়াতকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে। তাঁদের ইবাদতে-দাওয়াতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। তাদেরকে মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করার, এমনকি হত্যা করার চক্রান্ত করা হয়েছে। কাফিরদের এসব গর্হিত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের ফলে একদিকে যেমন তারা আল্লাহর কঠিন আযাবের উপযুক্ত হয়ে যেত অন্যদিকে এতে এই সকল নবীর জীবনে আল্লাহর রাহে কুরবানী, সবর ও মহাব্বতের কঠিন পরীক্ষাও হয়ে যেতো। এহেন কঠিন পরিস্থিতিতেই তাঁদের জীবনে নেমে আসতো হিজরতের আসমানী আদেশ। মাতৃভূমির আকর্ষণ ত্যাগ করে, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহর রাহে বাড়ি-ঘর ত্যাগের এই মহান গুরুত্বপূর্ণ আমল যেমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাঁদের জন্য খোদার প্রেমের কঠিন পরীক্ষা তেমনি তার অভ্যন-রে নিহিত থাকে আল্লাহর সাহায্যের সূচনা।
প্রথম হিজরতকারী হিসেবে হযরত আদম (আ.)-কে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি প্রথমে জান্নাতে বসবাস করছিলেন এবং পরবর্তীতে আল্লাহ পাকের হুকুমে দুনিয়ায় হিজরত করেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতে অস্তিত্ব দানের পর আদেশ করেছিলেন: “তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো, যা ইচ্ছা খাও-পান করো, কিন্তু এই গাছের নিকটবর্তী হয়ো না।”
শয়তান, যিনি আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিলেন, তিনি তার ওয়াসওয়াসার মাধ্যমে আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য করেন।
তিনি অনুতপ্ত হন, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন, “হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।”
আল্লাহ তাঁদের দোয়া কবুল করেন, তাঁদের দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। এভাবেই আদম (আ.)-এর দুনিয়ায় আগমনের মাধ্যমে মানবজাতির সূচনা ঘটে।
আমরা দেখি, অন্যান্য পয়গম্বরগণের জীবনেও হিজরতের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে—কারও হিজরত ছিল স্বীয় কওমের নির্যাতনের কারণে, আবার কারওটা ছিল আল্লাহর সরাসরি হুকুমে।
আদম (আ.)-এর পর যাঁর হিজরত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত, তিনি হলেন ইবরাহিম (আ.)।
তিনি নিজের পরিবারসহ হিজরত করেন এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করেন। তিনি বাবিল থেকে হাররান, উরফা হয়ে মিশরের দিকে রওনা হন এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে এসে থিতু হন।
সেটা ছিলো মূলত নমরূদের শহর, যেখানে দাওয়াত গ্রহণ বা কবুল করার মত কোনো মানুষ অবশিষ্ট ছিলো না। অত:পর তিনি মিশরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। মিশর থেকে ফিলিস্তিনের দিকে যেতে থাকেন। মিশরের যাত্রাকালে তার সাথে ছিলেন উম্মুল মু’মিনিন সাহারা (আ.)। সেখান থেকে তিনি ফিলিস্তিনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ফিলিস্তিনে আসার পর সাহারা যখন অনুধাবন করেন, তিনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম, তখন তিনি ইবরাহিম (আ.)-কে হাজেরা (আ.)-র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করান। হাজেরা (আ.)-র গর্ভে জন্ম নেন ইসমাইল (আ.)।
আল্লাহর হুকুমে ইবরাহিম (আ.) হাজেরা (আ.) ও শিশু ইসমাইলকে নিয়ে মক্কার ধূ-ধূ মরুভূমিতে হিজরত করেন। সূরা আনকাবুত-এর ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে—
“ইবরাহিম বললেন, আমি আমার রবের উদ্দেশে হিজরত করছি। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”
হাজেরা (আ.) যখন নবী ইবরাহিমকে যাত্রা পথে জিজ্ঞেস করলেন–
“হে ইবরাহিম, আমাদের যে এখানে রেখে যাচ্ছেন, এটি কি আল্লাহর হুকুম?”
তিনি জবাব দেন: “হ্যাঁ, এটি আল্লাহর আদেশ।”
তিনি একবাক্যে বলে ওঠেন: “তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের দেখভাল করবেন।”
পানি ও খাদ্য ফুরিয়ে গেলে হাজেরা (আ.) সাফা ও মারওয়ার পাহাড়ের মাঝে পানি খুঁজতে শুরু করেন। বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে যখন হতাশ হয়ে ফিরে আসেন, তখন দেখেন ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের আঘাতে একটি পানির ফোয়ারা তৈরি হয়েছে। এটি ছিলো যমযম কূপের সূচনা।
এই হিজরতে সবচেয়ে বড় ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরীক্ষা হাজেরা (আ.)-এর জীবনেই দেখা যায়। নবুওয়ত লাভের পর হতে তিনি নিজ মাতৃভূমির মানুষকে রাত-দিন দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করেনি তারা, ত্যাগ করেছে তার সঙ্গ। তাকে অকথ্য নির্যাতন করতেও দ্বিধা করেনি। দ্বিধা করেনি তাঁকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। তাঁর এই হিজরতের ফলে সূচিত হয় এক বিপ্লবের। আসে ব্যাপক সফলতা ও আল্লাহর সাহায্য। হিজরতের পর আল্লাহ তাঁকে অনেক নেক সন্তান-সন্ততি দান করলেন। তাঁর বংশে দেওয়া হল নবুওয়ত ও আসমানী কিতাব। এরপর পৃথিবীতে যত নবী তাশরীফ এনেছেন তারা সবাই হযরত ইবরাহীম আ.-এর বংশধর। এরপর যমীনে যত আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে তা নাযিল হয়েছে হযরত ইবরাহীম আ.-এর সন্তানের উপর। এটি আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান ও অপার অনুগ্রহ। কেননা, তিনি তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজ ভিটেমাটি ও স্বজন-পরিজনকে ত্যাগ করেছেন। এমন ভূমির দিকে হিজরত করেছিলেন যেখানে নিরাপদে আল্লাহর ইবাদত করা যায় এবং তাঁর পথে মাখলুককে দাওয়াত দেওয়া যায়।
এরপর মুসা (আ.)-এর কথা আসি, যিনি মিশর থেকে মাদায়িন হয়ে ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। তাঁর জীবনে আছিয়া (আ.) ও তাঁর মা—এই দুই নারীর অবদান অনস্বীকার্য। একজন, যিনি তাকে লালন-পালন করে বড় করে তুলেন। আরেকজন যিনি জন্মের পরপর কাঠের ভেলায় করে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। দুজনের ত্যাগ-তিতিক্ষাই ছিলো অবর্ণনীয়। তবে, সবচেয়ে বেশি যে নারীর অবদান তিনি হলেন আছিয়া (আ.)। যিনি তাকে নবুয়ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রক্ষা করেন, গড়ে তোলেন। ওহী নাজিলের পর দাওয়াত কবুল করেন, প্রতাপশালী জালিম ফিরআউনের সাথে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত শাহাদাত লাভ করেন।
নবুয়ত প্রাপ্তির পর মুসা (আ.) বনী ইসরাইল কওম-সহ ফেরাউনকে পরিত্যাগ করে হিজরত করেন। তিনি যখন লোহিত সাগরের সামনে পৌঁছান, আল্লাহর আদেশে লাঠির আঘাতে সাগর বিভক্ত হয়ে যায়। ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে পিছু ধাওয়া করলে সে সাগরের মাঝেই ডুবে মারা যায়।
এভাবে তিনি মিশর থেকে ফিলিস্তিন হিজরত করেন।
এই ধারায় হিজরত করেছেন আল্লাহর বহু নবী-রাসূলগণ। সকলের হিজরতের অক্লান্ত কষ্টের মাঝেই লুকিয়ে ছিল প্রাপ্তির সু-সংবাদ আর বিজয়ের সূচনা। নিহিত ছিল ইবাদাতের স্পৃহা আর ঈমানের তেজসহ আরো অসংখ্য হিকমত। যা আল্লাহই ভালো জানেন।
পয়গম্বর লুত (আ.)-এর কাহিনীও হিজরতের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি অশ্লীলতা ও অপবিত্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাঁর ঈমানদার উম্মতদের নিয়ে হিজরত করেন। তিনিই সেই নবী, যিনি একইসাথে তার উম্মতকে পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে পরিশোধিত করতে যখন তাকে হত্যার মুখোমুখি হতে হয়–তখন তার ওপর ইমান আনা কিছু বিশ্বস্ত উম্মতকে নিয়ে তিনি অন্যত্র হিজরত করেন।
তার স্ত্রী, সবচেয়ে আপনজন হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পাপ-পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে তার আন্দোলন যেন সফলতায় উপনীত না হতে পারে, এজন্য সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী নারী হলেন লুত (আ.)-এর স্ত্রী।
ঐ সকল খারাপ নারীসকলের মাঝে লুত (আ.)-এর স্ত্রীকেও উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের জাহান্নামের আজাব আরও বৃদ্ধি হোক বলে আশায়িত করা হয়েছে। কুরআনে তাঁর স্ত্রীকে অভিশপ্ত নারীদের কাতারে স্থান দেওয়া হয়েছে।
আরও এক নবী হলেন শু‘আইব (আ.), যিনি তাঁর কওমকে ব্যবসায়িক শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে গিয়ে নির্যাতিত হন এবং তাকে যখন তার কওম হত্যা করতে উদ্যত হলে তার আনীত বাণীকে যারা মেনে নিয়েছিলো, তাদের সাথে নিয়ে হিজরত করেন।
উলেখিত পয়গম্বরগণ হলেন তারা, যারা কওমকে সাথে নিয়ে হিজরত করেছেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আমরা পয়গম্বর ছাড়াও, শুধু উম্মতদের মাঝেও হিজরতের নজির দেখতে পাই। যেমন আসহাবে কাহাফ।
কুরআনে উল্লিখিত আসহাবে কাহাফ—যাঁরা আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেয় এবং যখন তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া শুরু করেন, তখন তাদের উপর বিভিন্ন ধরনের হুমকি আসা শুরু করে। তখন তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এক ও একত্বের দাবি নিয়ে হিজরত করে পাহাড়ের গুহায় এসে একত্রিত হন। তারা আশ্রয় নেয়ার পর পাহাড়ের গুহা সংকীর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহর অনুগ্রহে ৩০০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় সেখানে তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন।
তাঁদের ত্যাগ ও সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘সূরা কাহাফ’ নাজিল হয়।
তাঁরা ছিলেন সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষ, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা ধন-সম্পদ কোনোটারই অভাব ছিলো না। কিন্তু শুধুমাত্র এক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা সব ত্যাগ করেন। তাদের হিজরত নিছক জায়গা পরিবর্তন নয়, বরং ঈমানের বিনিময়ে দুনিয়ার সবকিছু ত্যাগের প্রতীক।
ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনাও একপ্রকার হিজরতের অন্তর্ভুক্ত। মা হারা ইউসুফ পিতার অধিকার আদরের ও স্নেহের হওয়ায়, সৎ ভাইদের হিংসার বশবর্তী হন। তার ভাইরা তাকে খেলার ছলে কূপের ভেতর ফেলে রেখে চলে গেলে কিছু বণিক এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে বণিকদের সাথে তাঁকে মিশরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এখন আমরা আসি সর্বশ্রেষ্ঠ হিজরতের দিকে—মুহাম্মদ (স.)-এর হিজরত।
মক্কায় দীর্ঘ তেইশ বছরের দাওয়াতি জীবনের পর নবীজি (স.) আল্লাহর হুকুমে মদিনায় হিজরত করেন। তাঁর পূর্বে সাহাবাগণ হাবশায় হিজরত করেছিলেন।
সর্বশেষ আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে তিনি মদিনার পথে যাত্রা করেন। মক্কার সীমান্তে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন,
“তুমি আমার নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় স্থান। যদি আমার কওম আমাকে নির্যাতন না করত, আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”
মদিনায় পৌঁছে মুহাজিরদেরকে আনসাররা এমনভাবে আপন করে নেন—তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ, এমনকি পরিবারও ভাগ করে নেন। মুহাম্মদ (স.)-এর এই হিজরতের মধ্য দিয়ে ইসলামের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়, যা বিশ্বসভ্যতার ভিত্তি রচনা করে।
উমর (রা.)-এর শাসনামলে হিজরত-কে ইসলামী সনের সূচনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকেই ইসলামের ইতিহাসের মাইলফলক ধরা হয়।
আজকের সময়েও হিজরত অব্যাহত।
সিরিয়া, সোমালিয়া, গাজা, আফ্রিকার বহু অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধা, নির্যাতন ও যুদ্ধের কারণে হিজরত করছে। কিন্তু আমরা কি আনসারদের মতো তাদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি?
আজ থেকে ১৫/১৬ বছর আগে, সিরিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা যখন তূর্কিতে এসেছিলো এবং এখন তারা ধীরে ধীরে পুনরায় তাদের দেশে যাওয়া শুরু করেছে। এই দীর্ঘ সময় তারা তখন তুর্কিতে ছিলো, তাদের সাথে আমরা আনসারদের মতো আচরন করতে পারিনি।
একই ভাবে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যতার কারনে সোমালিয়া থেকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে যারা এদেশে এসেছিলো, তাদের সাথেও আমরা আনসারদের মতো আচরন করতে পারিনি।
একইভাবে আজকে গাজায় যে গণহত্যা চলতেছে তাদের তো হিজরত করার মতো কোনো পথই নেই। তাদের পাশেও আমাদের পাশে যেভাবে দাঁড়ানোর কথা ছিলো সেটাও আমরা পারিনি।
আনসার হওয়ার অর্থ হচ্ছে যখন একজন মুহাজির, আমাদের দেশে আসবে, তখন আমাদের সকলকিছুকে তাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া। এটাই আমরা দেখতে পাই যখন মক্কা থেকে হিজরতকারী মুসলমানরা এসেছিলেন। তাদের ঘর, তাদের বাগান, অর্জিত টাকা পয়সা, সকলকিছুই তাদের সাথে বন্টন করে নিয়েছিলেন। অনেকেই আবার ভাগের অধিকাংশটুকুই সেসকল মুহাজিরদের মাঝে বন্টন করে দিয়েছিলেন।
আল্লাহর রসুল (সা.) আমাদের যে আদর্শ শিক্ষা দিয়েছিলেন সে আদর্শের পরিচয়ই আজকে আমাদের মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। কুরআনে বলা হয়েছে, “যতক্ষণ পর্যন্ত ইমান না আনবে অতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত ইমানে উপনীত হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সকল সম্পদ তোমরা দান করো যা তোমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে ভালোবাসো।
হিজরতকে যদি আমরা এভাবে নিজেদের অন্তরের অন্তঃস্থলে গেঁথে নিতে পারি তাহলে নিজের জায়গা, ভূমি বসত বাড়ি, দেশ ছেড়ে, খারাপ অভ্যাস থেকে ভালোর দিকে সকলের যাত্রা কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
তাই, আসল হিজরত শুধু ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়, বরং পঙ্কিলতা থেকে পবিত্রতার দিকে, অন্যায় থেকে ন্যায়ের দিকে যাত্রা।
নবীজি (স.) বলেছেন—
“আসল মুহাজির সেই, যে আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন এমন সবকিছু পরিত্যাগ করে।”
অর্থাৎ, কেউ যদি হাকিকি অর্থে কোনো হিজরতের লক্ষে বাধ্য হয় আল্লাহর রব্বুল আলামীন তাদের সাহায্য সহযোগিতা করুন, রহমত বর্ষন করুন। আবার, মাজেজী হিজরতের যেই হিকমত,খারাপ অভ্যাস থেকে ভালো অভ্যাসে, কদর্যতা থেকে সৌন্দর্যের দিকে, নিকৃষ্টতা থেকে ভালোর দিকে হিজরত–তা যেন আমাদের মধ্যে জাগ্রত থাকে, অবিরাম ভাবে হিজরতে অটল থাকতে পারি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন।
আজকের দিনে একটি ছেলেমেয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য যায়, সেটাও এক প্রকার হিজরত। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত—সবই একেকটি হিজরত। কারণ এগুলোর মাধ্যমে আমরা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হই।
যখন আমরা নামাজ পড়ি, দুনিয়ার সকলকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সামনে নিজেকে হাজির করি। এটাও ছোট একটা হিজরত।
একই ভাবে যদি রোজার কথা চিন্তা করি।
এটাও একটা শারীরিক ইবাদত যা আমাদের নফস কেন্দ্রীক আকাঙ্খা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সাহায্য করে। এটাও এক অর্থে হিজরত।
একইভাবে ইসলামের পাঁচটি বড় ইবাদতের একটি হচ্ছে হজ্ব। এই হজ্বও এক অর্থে হিজরত। কেউ যদি হাজ্বী হতে চায়, সে কী করে? তার বাংলাদেশ হোক, আমেরিকা হোক, এশিয়া হোক আফ্রিকা হোক, সকল জায়গা থেকে সে মূলত তার রবের দিকে যাত্রা শুরু করে– সত্যিকার অর্থেই হিজরত।
হজ্বে যখন একজন মানুষ যায়, তখন সে কাফনেএ কাপড়ের ন্যায় কাপড় পরিধান করে। কিছু সামান্য খাবার যদি থাকে, সাথে নিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পথের দিকে যাত্রা শুরু করে।
যখন ব্যক্তি তার উপার্জন থেকে অর্থ অর্জন করে তখন উত্তরোত্তর তার চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার জগত থেকে তাকে রক্ষা করে জাকাত। লোভ লালসার জগত থেকে তাকে রক্ষা করে তাকে উদার ও দানশীল হওয়ার পথে নিয়ে যায়। এই অর্থে জাকাতও একটা হিজরত।
নবীজী করিম (সা.) বলেছেন যে, “ফিতনার বা বিশৃঙ্খলালার সময়ে এগুলো থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বান্দা হওয়া বা ইবাদত করা এক অর্থে হিজরত।” তাই আমরা হাকিকী অর্থে, শারীরিক অর্থে হিজরত না হলেও খারাপের থেকে ভালোর দিকে, কদর্যতা থেকে ভালোর দিকে, আত্মিক উন্নতির দিকে হিজরতের যে মর্যাদা তা যেন লাভ করতে পারি।
যতদিন পর্যন্ত তওবার সুযোগ আছে, ততদিন পর্যন্ত হিজরতের দরজাও খোলা। যতদিন পর্যন্ত সূর্য উঠবে, ডুববে, ততদিন পর্যন্ত হিজরত জারি থাকবে। এর অর্থ কিয়ামত পর্যন্ত হিজরত জারি থাকবে। একইভাবে যে মুমিন সত্যিকার অর্থে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চায়, সকল ধরনের হারাম থেকে মুক্ত থেকে হয় মুহাজির নয়তো একজন আনসার হয়ে তার হৃদয়ের মদিনায় পৌছতে পারে।
অতএব,
কৃপণতা থেকে উদারতার দিকে,
বিভ্রান্তি থেকে হিদায়াতের দিকে,
অরাজকতা থেকে শৃঙ্খলার দিকে,
বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতার দিকে,
ঘৃণা থেকে ভালোবাসার দিকে,
হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দয়ার দিকে,
জুলুম থেকে ইনসাফের দিকে,
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে
বাতিল থেকে হকের পথে —এই প্রতিটি যাত্রাই হিজরত।
আমরা যেন এই হিজরতের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করি, এবং আল্লাহর দিকে অন্তরের ও কর্মের হিজরত অব্যাহত রাখি।
হিজরী নববর্ষ সকলের জন্য হোক বরকতময়।
আল্লাহ আমাদের সকল খারাপ দিক পরিত্যাগ করে ভালোর পথে হিজরত করার তাওফিক দান করুন।
সংকলন : আতিকা আঞ্জুম
