ইসলামী শিল্পকলার উপাদান হিসেবে নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্যের ধারণা

আখলাক ও নন্দনতত্ত্ব চিন্তা ও দর্শন

কোরআনের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য

কোরআনকে শুধু একটি ধর্মীয় বিধানসম্বলিত সংবিধান হিসেবে গণ্য করা ভুল হবে। বাস্তবিক অর্থে এটি “দ্বীন-ই মুবীন” ইসলামের পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন, আর ইসলাম নিজেই একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এই জীবনব্যবস্থা এমন একটি বিশ্বদর্শন উপস্থাপন করে, যেখানে একজন মুসলিমের সঙ্গে সমগ্র জগতের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ ও বর্ণনা করা হয়েছে।

বিশেষভাবে, কোরআনের ভাষাশৈলী ও সাহিত্যিক সৌন্দর্য আরবি ভাষা-সাহিত্যের এক অনন্য ভাণ্ডার। রাসূল (সা.)-এর অন্যতম বিরোধী ওয়ালিদ বিন মুগীরা পর্যন্ত পবিত্র কোরআন সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন:

 “আমি মুহাম্মদের কোরআন পাঠ শুনেছি এবং বুঝেছি—এটি কোনো মানুষের কিংবা জিনের রচনা হতে পারে না। এর ভাষার যে কম্পনসঞ্চারী শক্তি, সাহিত্যের অলংকার, পূর্ণতা, হৃদয়গ্রাহী রচনাশৈলী, সমুদ্রতুল্য তরঙ্গময়তা, বাকভঙ্গির বৈচিত্র্য ও মাধুর্য—তার তুলনা কোথাও পাওয়া গেছে কি? এমন ভাষা কোথাও লেখা হয়েছে কি আদৌ?”

কোরআনে “জামাল” (সৌন্দর্য) শব্দের ব্যবহার

পবিত্র কোরআনে “জামাল” শব্দটি মোট ৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে এবং আলাদা তাৎপর্য বহন করে। নিচে এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো:

১. সূরা ইউসুফ, আয়াত ১৮:

“তারা তার (ইউসুফ আ.) জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে আনলো। পিতা (ইয়াকুব আ.) বললেন, ‘না, বরং তোমাদের প্রবৃত্তি তোমাদেরকে এক কাহিনী বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সুতরাং ধৈর্য ধারণই শ্রেয়। তোমরা যা করেছো সে বিষয়ে আল্লাহই আমার সাহায্যকারী।’”

২. সূরা ইউসুফ, আয়াত ৮৩:

“ইয়াকুব (আ.) বললেন, ‘না, তোমরাই কাহিনী রচনা করেছো। অতএব ধৈর্য ধারণই উত্তম। আল্লাহ আশা করা যায় তাদের সবাইকে একত্রে ফিরিয়ে দেবেন। তিনিই সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’”

৩. সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত ৫:

“অতএব, উত্তমভাবে ধৈর্য ধারণ করো।”

৪. সূরা যুমার, আয়াত ১৭:

“তারা যা বলে, তাতে ধৈর্য ধারণ করো এবং তাদেরকে উপেক্ষা করো উত্তমভাবে।”

৫. সূরা ছাদ, আয়াত ২৭:

“আমি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং এদের মাঝের সব কিছু অসার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। কিয়ামত অবশ্যই আসবে, তাই তাদেরকে সুন্দরভাবে উপেক্ষা করো।”

৬. সূরা আল-আহযাব, আয়াত ২৮:

“হে নবী! তোমার স্ত্রীদের বলো—যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার শোভা কামনা করো, তবে এসো, আমি তোমাদের কিছু দিয়ে বিদায় করে দেবো উত্তমভাবে।”

৭. সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৪৯:

“যখন কোনো মুমিন নারীকে বিয়ে করে তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দেওয়া হয়, তখন তাদের কোনো ইদ্দত নেই। তাদেরকে কিছু সামগ্রী দিয়ে সম্মানের সাথে বিদায় দাও।”

৮. সূরা আন-নাহল, আয়াত ৫:

“তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন চতুষ্পদ জন্তু, যেগুলোর দ্বারা তোমরা উষ্ণতা লাভ করো, বিভিন্ন উপকার পাও, আর সেগুলোর থেকে আহার গ্রহণ করো।”

উপরোক্ত আয়াতসমূহ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ‘জামাল’ (সৌন্দর্য) শব্দটি এখানে শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ বা দৃশ্যগত সৌন্দর্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়নি। বরং এই শব্দটি গভীর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মানে বহন করে—যেমন ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সৌজন্য ও মার্জনা।

ইবনে কাসির (রহ.) মন্তব্য করেন—“সুন্দর ধৈর্য হলো এমন ধৈর্য, যার সঙ্গে ভয়, অস্থিরতা বা অভিযোগের স্থান নেই।”

রাসূল (সা.)-কে একবার ‘জামিল সবর’ (সুন্দর ধৈর্য) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,

“জামাল হলো এমন কিছু—যার বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকে না। আর সবর হলো এমন এক মূল্যবান রত্ন—যার কোনো বিকল্প নেই।”

সূরা মুযাম্মিল, আয়াত ১০:

“তারা যা বলে, সে বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করো, আর সম্মানের সঙ্গে তাদেরকে উপেক্ষা করো।”

অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যারা অবিশ্বাস করে মিথ্যা আরোপ করছে, তাদের কটূক্তির প্রতিশোধ নেওয়া নয়; বরং ধৈর্য ধারণ করে মর্যাদাসম্পন্ন আচরণ করাই শ্রেয়।

সূরা আল-হিজর, আয়াত ৮৫-এও একইরূপ নির্দেশ রয়েছে—ক্ষমা ও সৌজন্যমূলক পরিহার।

সূরা আল-আহযাবের ২৮-২৯ নং আয়াত মুসলিম নারীদের জন্য একটি মানবিক ও মর্যাদাসম্পন্ন সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত। যেখানে স্ত্রীদের বলা হয়েছে—তারা চাইলে রাসূলের দারিদ্র্যসঙ্কুল জীবনে অংশ নিয়ে পরকালীন সম্মান অর্জন করতে পারে অথবা সম্মানের সঙ্গে তালাক গ্রহণ করে দুনিয়ার পথে চলতে পারে। দুটি অবস্থাতেই রয়েছে সৌন্দর্য, সম্মান ও নৈতিক ভারসাম্য।

কোরআনের আলোকে সৌন্দর্য ও তার তাৎপর্য

সূরা আল-নাহলের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে—

“তোমরা যখন গোধূলি লগ্নে তাদেরকে চারণভূমি থেকে গৃহে নিয়ে আসো এবং প্রভাতে যখন তাদেরকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করো।”

এই আয়াতটি বাহ্যিক দৃশ্যমান সৌন্দর্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে—যেমন, গৃহপালিত পশুর চলাফেরা, সুশৃঙ্খল গতি, ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মোহনীয় রূপ। এতে আমরা দেখতে পাই, কোরআনে ‘সৌন্দর্য’ শব্দটি দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে:

১. আখলাকী বা নৈতিক সৌন্দর্য – যেমন: ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা, সহিষ্ণুতা।

২. বাহ্যিক বা দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য – যেমন: প্রকৃতি, সৃষ্টি, সাজসজ্জা ইত্যাদি।

কোরআনে সৌন্দর্যের প্রতিশব্দসমূহ

১. “যিনাতুন” (زينَةٌ) – সুশোভিত / শোভা

সূরা আন-নামল, আয়াত ২৪:

 “…শয়তান তাদের কার্যাবলিকে তাদের দৃষ্টিতে শোভন করে দিয়েছে এবং তাদের সৎ পথ থেকে নিবৃত্ত করেছে…”

সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ২৫:

“…তাদের সম্মুখ ও পশ্চাতে যা আছে, তা তাদের জন্য শোভন করে দেখানো হয়েছিল…”

সূরা আন-নূর, আয়াত ৩১:

এখানে ‘যিনাতুন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে নারীদের অলংকার, সাজসজ্জা ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের অর্থে।

সূরা আল-মুলক, আয়াত ৫:

“আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালায়…”

সূরা কাফ, আয়াত ৬:

“…আমি আসমানকে বানিয়েছি এবং সুশোভিত করেছি…”

২. “হুসন” / “হাসান” (حُسْنٌ / حَسَنٌ) – উৎকর্ষ, মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য

সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত ১৪:

“…অতঃপর আমি তাকে এক নতুন সৃষ্টিতে উন্নীত করি। সুতরাং সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কতই না মহান।”

সূরা আয-যুমার, আয়াত ২৩:

“আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী অবতীর্ণ করেছেন…”

সূরা আয-যুমার, আয়াত ১৮:

“…তারা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং যা উত্তম তা অনুসরণ করে…”

সূরা আল-আহকাফ, আয়াত ১৬:

“আমি তাদের সৎকাজ গ্রহণ করি এবং মন্দ কাজ ক্ষমা করি…”

সূরা আত-তীন, আয়াত ৪:

“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে।”

সূরা আল-মুমিন, আয়াত ৬৪:

“…তিনি তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন এবং আকৃতিকে সুন্দর করেছেন…”

সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৫২:

“…যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করে…”

সূরা মারইয়াম, আয়াত ৭৪-৭৫:

“…যারা সাজসজ্জা ও বাহ্যিক সৌন্দর্যে শ্রেষ্ঠ ছিলো…”

এই সকল আয়াতে ‘হুসন’ বা ‘হাসান’ শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে মানুষের চেহারা, আকৃতি, আচরণ এবং আখলাকের সৌন্দর্যকে।

কোরআনের ভাষায় সৌন্দর্যের দুইটি দিক:

১. আখলাকী সৌন্দর্য (নৈতিকতা, সহনশীলতা, বিনয়, দয়া) – কোরআনে যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

২. বাহ্যিক সৌন্দর্য (প্রকৃতি, রূপ, শৈল্পিকতা) – যা চোখে ধরা পড়ে।

রাসূল (সা.)-এর চরিত্রে সৌন্দর্যের প্রকাশ

আল্লাহ তায়ালা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাঁর রাসূল (সা.)-এর নৈতিক সৌন্দর্য ও চরিত্রের মহত্বকে তুলে ধরেছেন। তিনি মানবতার মুক্তির প্রতীক, দয়ার আধার, হিংসা ও প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির ধারক।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার হলো সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা।” (সহীহ মুসলিম)

এই হাদীসে সৌন্দর্যের প্রকৃত মাপকাঠি নির্ধারিত হয়েছে। যা মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণাবলি ও বিনয়-ভদ্রতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

সৌন্দর্যের বিপরীত হলো অহংকার। আল্লাহ বলেন-সূরা লোকমান, আয়াত ১৮:

“…অহংকার করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না… নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিককে পছন্দ করেন না।”

সূরা গাফির, আয়াত ৬০:

“…যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে যাবে।”

রাসূল (সা.) বলেন:

“জাহান্নামীদের মধ্যে হলো, সেই ব্যক্তি যে রূঢ় স্বভাবের, কঠোর হৃদয়ের এবং অহংকারী।”

সার্বিকভাবে কোরআন ও হাদীসে সৌন্দর্যকে দুই রূপে তুলে ধরা হয়েছে—আখলাকী সৌন্দর্য এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য। তবে ইসলামে আখলাকী সৌন্দর্যের স্থান সর্বোচ্চ। কেননা, এটাই একজন মুমিনের ব্যক্তিত্বের প্রকৃত পরিচায়ক এবং জান্নাতপ্রাপ্তির মাধ্যম।

সৌন্দর্য যদি অহংকার সৃষ্টি করে—তাহলে তা ইবাদতের অন্তরায় হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, বিনয় ও নৈতিক সৌন্দর্য একজন মানুষকে আল্লাহর প্রিয় বান্দার কাতারে স্থান দেয়। তাই, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক নয়, বরং গভীরভাবে আখলাকী ও আত্মিক একটি গুণ, যা ঈমান ও মানবিকতার প্রতিফলন।

রাসূল (সা.) ও ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য ও তার প্রকৃতি

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন—সৌন্দর্য বলতে শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ নয়, বরং অন্তরের সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য। তাঁর দৃষ্টিতে সৌন্দর্য হচ্ছে উত্তম চরিত্র, সদাচরণ, দয়ার গুণ, নম্রতা এবং বিনয়। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, কেবল চেহারা, পোশাক বা বাহ্যিক সাজসজ্জা যেন সৌন্দর্যের একমাত্র মাপকাঠি না হয়। বরং সৌন্দর্যের প্রকৃত মানদণ্ড হতে হবে—ভালো ব্যবহার, উত্তম আচরণ, ও নৈতিক গুণাবলির প্রতিফলন।

রাসূল (সা.) বলেন:

“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার চরিত্র সর্বোত্তম।”

(সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

আরও বলেন:

“মানুষ জান্নাতে সবচেয়ে বেশি যে গুণটির কারণে প্রবেশ করবে, তা হলো উত্তম চরিত্র।”

অর্থাৎ, রাসূল (সা.) বাহ্যিক ও আত্মকেন্দ্রিক, আত্মপ্রদর্শনমূলক সৌন্দর্যকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, যে ব্যক্তি অহংকার ও আত্মগরিমা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সে জান্নাতপ্রবেশ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

হাদীসে এসেছে:

“যে ব্যক্তি জাঁকালো পোশাকের পরিবর্তে নম্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবেন।”

একজন সাহাবি একবার বললেন,

“হে আল্লাহর রাসূল, আমি সৌন্দর্যকে ভালোবাসি, এবং মানুষের প্রশংসাও ভালো লাগে।”

রাসূল (সা.) উত্তরে বললেন,

“তোমাকে এতে বাধা দিচ্ছে কে?”

অর্থাৎ, ইসলাম সৌন্দর্য, রুচিশীলতা ও শৈল্পিকতা গ্রহণ করে এবং উৎসাহিত করে—যতক্ষণ না তা অহংকার, আত্মপ্রদর্শন বা দাম্ভিকতায় পরিণত হয়। সুন্দর পোশাক পরা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, পরিপাটি আচরণ করা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত, যদি তা বিনয়ের সঙ্গে হয়।

শতাব্দী-শ্রেষ্ঠ মুসলিম চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য

সৌন্দর্য একটি বহুমাত্রিক ও দর্শনভিত্তিক ধারণা। ইতিহাসের মহান মুসলিম দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ সৌন্দর্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন এবং নন্দনতত্ত্বের ভিত্তিতে তা বিশ্লেষণ করেছেন।

আবু হাইয়ান আল-তাওহীদি (৯২২–১০২৩ খ্রিস্টাব্দ)

বাগদাদে বেড়ে ওঠা এই সাহিত্যিক ও দার্শনিককে ইয়াকুত আল-হামাভি “সাহিত্যিকদের দার্শনিক ও দার্শনিকদের সাহিত্যিক” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সৌন্দর্যকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন:

১. আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য – যা অন্তরকে আলোকিত করে, পরিবর্তনশীল নয় এবং কেবল একটি বিশুদ্ধ হৃদয় তা উপলব্ধি করতে পারে।

২. বাহ্যিক সৌন্দর্য – যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সমাজ-সংস্কৃতি-শ্রেণিভিত্তিক।

তিনি মনে করতেন, স্রষ্টার সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য সুফিবাদ ও আত্মশুদ্ধির চর্চা প্রয়োজন। বস্তুগত সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য চাহিদা ও রুচির প্রয়োজন।

ইবনে হাজম আল-আন্দালুসি (৯৪৪–১০৬৩ খ্রিস্টাব্দ)

এই আন্দালুসি ফকীহ ও কবি বিশ্বাস করতেন, সৌন্দর্যের তিনটি মৌলিক উপাদান আছে:

১. দয়ার্দ্রতা

২. কোমলতা

৩. হিকমত (প্রজ্ঞা)

তিনি সৌন্দর্যকে দুইভাবে চিহ্নিত করেছেন:

বাহ্যিক দিক: চেহারা, অঙ্গভঙ্গি, চলাফেরা

আভ্যন্তরীণ দিক: আচরণ, মূল্যবোধ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

তিনি বলেন:

“পরিশুদ্ধ আত্মা সদা ভালো কিছুর প্রতি অনুরাগী। আত্মার শুদ্ধতার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব।”

ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালী (১০৫৮–১১১১ খ্রিস্টাব্দ)

ইসলামী দার্শনিকতার শ্রেষ্ঠ প্রতিভা গাজ্জালী বিশ্বাস করতেন যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান মুসলিম সমাজে বিলুপ্ত হতে বসেছে, তাই তিনি লিখেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন।

তিনি সৌন্দর্যকে তিনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন:

১. চোখ দিয়ে অনুভবযোগ্য সৌন্দর্য

২. হৃদয় দিয়ে উপলব্ধিযোগ্য সৌন্দর্য

3. আখলাক বা নৈতিক সৌন্দর্য

ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩–১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ)

তিনি হাম্বলী ফিকহের একজন জ্যেষ্ঠ আলিম ও চিন্তাবিদ ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে—

অন্তরের প্রশান্তি ও ঈমানের মাধুর্য বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অধিক মূল্যবান। বাহ্যিক রূপ যদি অহংকার সৃষ্টি করে, তবে তা আল্লাহর দৃষ্টিতে ঘৃণিত। সৌন্দর্য যদি মূল্যবোধ ও চরিত্রশূন্য হয়, তবে তা কেবল ফাঁপা আবরণ।

তিনি কোরআনের একটি আয়াত উদ্ধৃত করেন:

“বলুন, আমার রব অশ্লীলতা হারাম করেছেন—চাই তা প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন। এবং পাপকাজ, সীমালঙ্ঘন, মিথ্যা, শরীক এবং অজ্ঞতাবশত আল্লাহর নামে কথা বলা—সবই হারাম।”

(সূরা আল-আরাফ: ৩৩)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“আল্লাহর চেয়ে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আর কেউ নেই, তাই তিনি অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন। আল্লাহর চেয়ে অধিক প্রশংসাপ্রিয়ও কেউ নেই।”

সৌন্দর্য একটি সামগ্রিক ও পরিশীলিত গুণ, যা বাহ্যিক রূপ ছাড়াও অন্তরের ঔজ্জ্বল্য ও নৈতিকতার পরিপূর্ণ প্রকাশ। কোরআন ও হাদীস যেমন তা ব্যাখ্যা করেছে, তেমনি মহান চিন্তাবিদগণও নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৌন্দর্যের মূল্যায়ন করেছেন। বাহ্যিক সৌন্দর্যকে সম্মান দেওয়া হলেও ইসলাম বারবার অন্তরের সৌন্দর্য ও উত্তম চরিত্রের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

সত্যিকার সৌন্দর্য হলো সেই, যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এ ধরনের সৌন্দর্যই মানুষের ঈমান, মানবিকতা ও জান্নাতের পথে সহায়ক হয়।

ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ ও সৌন্দর্য বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি

ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ ৬৯১ হিজরির সফর মাসের ৭ তারিখে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদরাসাতুল জাওযিয়াহ-তে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং স্বীয় যুগের বহু প্রখ্যাত আলেম থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। তবে তার অন্যতম ও প্রধান উস্তাদ ছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)। ইতিহাস অনুযায়ী, ৭১২ হিজরিতে ইবনে তাইমিয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়, এবং এরপর থেকে শায়খের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন। জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে কারাগার—প্রত্যেকটি মুহূর্তে তিনি উস্তাদের পাশে ছিলেন।

এই দীর্ঘ সাহচর্যের ফলে তিনি ইবনে তাইমিয়ার ইলম ও চিন্তার প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে ওঠেন। তিনি ইসলামী আকীদা, তাওহীদ, তাফসীর, হাদীস, ফিকহ এবং উসূলুশ-শরীয়াহ বিষয়ে অনন্যসাধারণ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।

ইবনুল কাইয়্যিমের মতে, সৌন্দর্য দুই প্রকার:

১. দৃশ্যত (যাহেরী) সৌন্দর্য – বাহ্যিক রূপ, আকৃতি ও দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য

২. লুকায়িত (বাতেনী) সৌন্দর্য – হৃদয়, চরিত্র, বোধ, জ্ঞান, সততা ও যুক্তিনির্ভর গুণ

তিনি বলেন:

“অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য এমন এক গুণ, যা বাহ্যিক সৌন্দর্যকে আরও শোভন করে তোলে—এমনকি যদি বাহ্যিকটি নিখুঁত না-ও হয়।”

অতএব, বাহ্যিক সৌন্দর্য আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যই পরম ও স্থায়ী। যদিও বাহ্যিক সৌন্দর্য আল্লাহর একটি নিয়ামত, তথাপি প্রকৃত মূল্য বহন করে সেই সৌন্দর্য যা অন্তর থেকে বিকশিত হয়।

ইসলামে সৌন্দর্যের পূর্ণাঙ্গতা

ইসলাম ব্যক্তি-জীবনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ—উভয় রূপেই সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে বাহ্যিক সৌন্দর্য যতই আকর্ষণীয় হোক, যদি অন্তর, মনোভাব ও আচার-আচরণ কলুষিত হয়, তবে সে সৌন্দর্য মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

যদি একজন ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে পরিপাটি হলেও তার ভাষা হয় অশ্রাব্য, ব্যবহারে থাকে হিংস্রতা, পোশাকে অশোভনতা ও খাদ্যাভ্যাসে থাকে অশিষ্টতা—তবে এমন মানুষকে রুচিশীল বলা যায় না। অপরিচ্ছন্ন জীবন, নোংরা চালচলন ও গুণহীন আচরণ কখনোই ইসলামি রুচিবোধের প্রতিফলন হতে পারে না।

ইসলামে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যে উৎসাহ

ইসলাম সাজসজ্জা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যকে উৎসাহিত করে। একজন ব্যক্তি যদি সুন্দরভাবে পোশাক পরেন, সুন্দর জুতা পরেন, তা কখনোই অহংকার নয়, যতক্ষণ না তার আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়।

অতএব, বাহ্যিক সৌন্দর্যকে সম্মান করার পাশাপাশি তা যেন বিনয়, নম্রতা ও সত্যবাদিতার সাথে সম্পৃক্ত হয়—সেই দিকেই ইসলাম আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়।

উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যায়, ইসলামী সভ্যতার মহান চিন্তাবিদগণ, আলেমগণ ও রাসূল (সা.) এর শিক্ষা—সবখানেই সৌন্দর্য একটি পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ ধারণা। বাহ্যিক সৌন্দর্য যতক্ষণ না তা আখলাক ও ঈমান দ্বারা সমর্থিত, ততক্ষণ তা শুধুই একটি আবরণ মাত্র।

সত্যিকারের সৌন্দর্য হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার ঋদ্ধতা ও ব্যবহারিক উত্তম আচরণে প্রতিফলিত হয়। তাই ইসলাম শুধু চেহারার সৌন্দর্য নয়—মন ও রূহের সৌন্দর্যকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

লেখক পরিচিতি

ড. মুজিব আল-জাহরানি

কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের শিল্প শিক্ষা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। ইসলামী শিল্পকলায়, ইসলামে নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্যের ধারণা নিয়ে তাঁর বহু গবেষণা রয়েছে। এই প্রবন্ধটিও তাঁর চিন্তাশীল ও মননভিত্তিক কাজের একটি দৃষ্টান্ত।

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *